ভরা পদ্মা ঘিরে যৌবন ফিরেছে মাদক কারবারিদেরও

নিজস্ব প্রতিবেদক:


বর্ষা মৌসুম শেষে প্রমত্তা পদ্মা যেন মরুভূমিতে পরিণত হবে। পানিতে টইটুম্বুর পদ্মা এখনো যৌবনা এক নারীর মতো। চারিদিকে পানি থৈ থৈ। পদ্মার মতো রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারিরাও যেন ভরা যৌবনে ফিরেছেন। প্রতি বছর এই বর্ষায় মাদকারবারিরা পদ্মার পানিকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে ভারত থেকে মাদক পাচার করে নিয়ে আসতে পারে। সন্ধ্যার পরে মাছ ধরা নৌকায় করে বা ওপার থেকে পলিথিনে বেধে ভারি কিছুর সঙ্গে মাদক ডুবিয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে আসা হয় এপারে।

যা খরা মৌসুমে পদ্মা শুকিয়ে গেলে সম্বব হয় না। দুর্গম পদ্মার চরে এমনিতেই আইনশ্খৃলা বাহিনী তেমন তৎপরতা থাকতে পারে না। এর ওপর ভরা পদ্মায় আরও দূরহ হয়ে পড়ে সীমান্ত পাহারা দেওয়া। আর সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে এই সময়ে প্রতি বছরের মতো মাদক কারবারিরা এবারো সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন: রাজশাহীতে ক্ষুদে আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালান বাড়েছ!

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য ও সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ভরা পদ্মায় মাদকের ব্যবসা প্রসারিত করতে এলাকায় ফিরে এসেছেন গোদাগাড়ীর শীর্ষ সেই মাদকার কারবারিরাও। যাদের মধ্যে রয়েছেন মাটিকাটার সোহেল রানা, নয়ন ডাক্তার, শীষ মোহাম্মদ, আব্দুর রহিম টিপু প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে ভোট করতেও প্রচারণায় নেমেছেন মাদকের টাকার বস্তা নিয়ে। আবার কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে না চাইলেও সহযোগিতা করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের। এলাকায় ক্ষমতা ফিরে পেতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আড়ালে আবারো তৎপরতা চালাচ্ছেন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভারতীয় সীমান্ত এলাকার মাদক কারবারিরা।

সরেজমিন রাজশাহীর পবা উপজেলার বেড়পাড়া এলাকায় শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, সন্ধ্যার আগ থেকেই ছোট ছোট শ্যালো মেশিন চালিত ডিঙ্গি নৌকাগুলো মাছ ধরার জন্য মাঝ নদীতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারাদিন এসব নৌকাগুলো অলস পড়ে থাকে নদীর পাড়ে। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই মাছ ধরার নামে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় গিয়ে অৎ পেঁতে থাকে এই নৌকাগুলো। ওপার থেকে মাদক নিয়ে পরে গভীর রাতে ফিরে আসে। কোনো নৌকা আসে বস্তাভর্তি ফেনসিডিলি নিয়ে। আবার কোনো কোনো নৌকার সঙ্গে দড়ি বেধে দিয়ে ফেনসিডিলের বস্তা পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এর পর মাছ ধরার কৌশলে আস্তে আস্তে এপারে তীরে এসে সুযোগমতো দড়ি টেনে ফেনসিডিলভর্তি বস্তা ওপরে তুলে পাচার করা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

পবার বেড়পাড়া এলাকার মাহবুল হোসেন জানান, ‘ভরা পদ্মাকে কাজে লাগিয়ে এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা এখন সমানে মাদক পাচার করে নিয়ে আসছে ভারত থেকে। এখন অনেকটা সহজেই ওপার থেকে মাদক নিয়ে আসতে পারছে নৌকাযোগে। কিন্তু পদ্মা সুকিয়ে গেলে মাথায় করে ফেনসিডিল পরিবহণ সহজ হয়ে ওঠে না। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বেশি থাকে। কিন্তু এখন দুর্গম চরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেভাবে পাহারা দিতে পারে না রাতে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পানিতে ভাসিয়ে মাছ ধরা নৌকাযোগে ফেনসিডিল পাচার হচ্ছে ব্যাপক হারে।’

সূত্র মতে, ২০১৯ সালে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পরে কোটিপতি বনে যাওয়া শীর্ষ দামক কারবারিরা অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কালের কণ্ঠের সংবাদের পরে দুই কোটি টাকার হেরোইন ও অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী শীষ মোহাম্মদ, কোটি টাকার মাদকসহ গ্রেপ্তার হন গোদাগাড়ী পৌর সভার কাউন্সিলর মফা। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান মাটিকাটার সোহেল, মহিষালবাড়ী এলাকার শহিদুল ইসলাম ওরফে ভোদল। জামায়াত নেতা হযরত আলীসহ আরও অনেকেই। কিন্তু তাদের মধ্যে মফা কারাগারে রয়েছেন। অন্যরা এখন এলাকায় ফিরেছেন। কেউ রাজশাহী শহরে বসে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোড়াদাড়ীর ডিমভাঙ্গা এলাকায় একটি ক্লাব ঘরকে গেন্দ্র করে প্রতিদিন রাতে বসে মাদক কারবারিদের আড্ডা। উপজেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের আড্ডা বসে গোদাগাড়ী পৌর সভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল জব্বারের ছত্রছায়ায়।

তবে দলীয় নেতাকর্মীরা ছাড়া কেউ ওই ক্লাবে আসার সুযোগ নাই বলে দাবি করেন কাউন্সিলর আব্দুল জব্বার।
উপজেলার মহিষালবাড়িতে আরেক মাদক ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান কাজলের নেতৃত্বে বসে অপর একটি মাদক চক্রের গ্রুপের আড্ডা। এরা ছলে বলে কৌশলে এখান থেকে মাদকের টাকার দেন-দরবার করে থাকে।

অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভারতীয় সীমান্ত এলাকাজুড়ের এখন মাদকের বিস্তার চরমে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। গত ৪ সেপ্টেম্বর এ জেলার বারঘরিয়া এলাকা থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের হেরোইনসহ তিন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এর বাইরেও গত দুই মাসে শুধুমাত্র এ জেলা থেকেই বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্তত ১০ কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করেছে। যার মধ্যে হেরোইন ও ফেনসিডিলই বেশি। যেগুলো ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করে নিয়ে আসা হয়েছে।

মাদকের এই অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘বর্ষায় মাদক কারবারিদের তৎপরতা বেড়েছে এই ধরনের তথ্য আমার কাছে নাই। তবে আমরা মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অনেকেই জামিনে এসে এলাকায় কৌশলে অবস্থান করছে। তাদের বিষয়েও আমরা খোঁজ-খবর রাখছি।’

স/আর