বড় পরিবর্তন ছাড়াই পাস হচ্ছে বাজেট

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর কাঠামো নিয়ে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের আপত্তি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কিছু সংশোধনীর প্রস্তাবও রয়েছে। যদিও এতে পরিবর্তন আসছে সামান্যই। বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ২৮ জুন জাতীয় সংসদে পাস হচ্ছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট। এর একদিন আগে ২৭ জুন পাস হবে অর্থবিল-২০১৮।

নির্বাচনী বছর হওয়ায় বাজেটে অগ্রাধিকার দেয়া খাতের বরাদ্দ ঠিকই থাকছে। কোনো পরিবর্তন আসছে না আয়-ব্যয়ের কাঠামোতেও। কর কাঠামোর মধ্যে আয়কর অপরিবর্তিত রেখেই চূড়ান্ত অর্থবিল প্রস্তুত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট কাঠামোয় সামান্য সংশোধন আসছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও চলতি অর্থবছরের বাস্তবায়ন বিবেচনায় নিয়েই আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনেক হোমওয়ার্কের মাধ্যমে বাজেট প্রস্তুত করেছেন। ফলে বাজেটের আকার, বরাদ্দ ও নীতি-কাঠামোয় খুব বেশি পরিবর্তন আসছে না। তবে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা ও ভোক্তা চাহিদার কথা বিবেচনা করে শুল্ক ও ভ্যাটে সামান্য পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

শুল্ক ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, মোবাইল ও কম্পিউটারের সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যার আমদানিতে বেশকিছু খাতে শুল্ক অনেক বেশি কমানোর কারণে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির আশঙ্কা করছিল। এসব জায়গায় কিছু পরিবর্তন আসছে। অন্যান্য শিল্পের বেশকিছু খাতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব থাকলেও প্রথমে তা হয়নি। তবে চূড়ান্ত বাজেটে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ভ্যাটের ক্ষেত্রে কিছু কিছু এইচএস কোডে ঝামেলা তৈরি হয়েছিল। সেগুলো সংশোধন করা হয়েছে। ইস্পাতপণ্যের ভ্যাটের ক্ষেত্রেও সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে।

বাজেট প্রস্তাবের পর সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে করপোরেট করহার ও ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা নিয়ে। ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য কোম্পানির করহার গড়ে আড়াই শতাংশীয় পয়েন্ট কমানোর প্রস্তাব রয়েছে ব্যবসায়ীদের। অন্য কোনো ক্ষেত্রে করহার না কমিয়ে শুধু ব্যাংকের জন্য কমানোর কারণে সমালোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদেও। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় করপোরেট করহার সংশোধন করে অন্যান্য ক্ষেত্রেও তা কমানোর দাবি জানিয়েছে সব ব্যবসায়ী সংগঠন। তবে এটা অপরিবর্তিত রেখেই চূড়ান্ত হয়েছে আয়কর কাঠামো। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকলেও তাতে পরিবর্তন আসছে না। তৈরি পোশাক খাতে মুনাফা কর ও উেস কর বাড়ানোর কারণে এ শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হয়েছে। তার পরও পরিবর্তন আসছে না এক্ষেত্রে। অপরিবর্তন থাকছে মুনাফায় বারবার কর, রাইড শেয়ারিংয়ের ওপর কর, কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা প্রয়োগ, বেতনভোগীর রাজস্ব ফাঁকিতে প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার বিধানও। যদিও এগুলোয় সংশোধনের প্রস্তাব রয়েছে।

ভ্যাটের ক্ষেত্রে আদায় ও ভ্যাট হারে কোনো পরিবর্তন আসছে না চূড়ান্ত বাজেটে। যদিও বাজেট ঘোষণার পর অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট ৪ থেকে বেড়ে ৫ শতাংশ, অ্যাপসভিত্তিক পরিবহনে ভ্যাট আরোপ, পিভিসি পাইপের ভ্যাট ৩ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশে উন্নীতকরণ, সুপারশপে ভ্যাট বৃদ্ধিসহ বেশকিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল ব্যবসায়ীদের। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পে ভ্যাট প্রত্যাহার না করার বিরোধিতাও করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও এসব বিষয়ে আগের অবস্থানেই রয়েছে এনবিআর। ভ্যাটের ক্ষেত্রে শুধু জর্দা-গুলের এসআরওতে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো কয়েকটি পণ্যে তা কিছুটা কমানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে এনবিআর সূত্র।

জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় মুদ্রণজনিত ভুলের কারণে ভ্যাটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ হার, ভ্যাটের স্তর ও অনলাইনে কেনাকাটায় ভ্যাট আরোপসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এসব বিষয়ও এরই মধ্যে সংশোধন করেছে এনবিআর। ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ ও ছয়টি স্তর রাখা হয়েছে আগামী অর্থবছরের জন্য। অন্যদিকে ভার্চুয়াল লেনদেন বলতে গুগল ও ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের লেনদেনকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে সাধারণ অনলাইন কেনাকাটা ভ্যাটের বাইরে থাকছে।

অন্যদিকে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি, লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি, ভাইব্রেটর, মোটর, রিসিভার, ইয়ারফোন বাটন, বিভিন্ন যন্ত্রাংশের কাভার, ইউএসবি, ওটিজি কেবলসহ মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারসামগ্রী উৎপাদনে সহায়ক ৪৪টি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এসব ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসছে চূড়ান্ত বাজেটে।

প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক পণ্যের শুল্কহার ২৫ থেকে শূন্য শতাংশ করা হলেও এখানে শূন্য থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ হচ্ছে। আর ডাটাবেজ, প্রডাক্টিভিটি সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্ক সর্বক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব থাকলেও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় পণ্যভেদে আলাদা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিল্পের লিফ স্প্রিংয়ে শুল্ক কমানো হলেও চূড়ান্ত বাজেটে তা আগের অবস্থানে নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে এর কাঁচামাল ফ্ল্যাটবারের বিদ্যমান শুল্কহার ৪৫ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। শুল্কহার কমছে আরো কয়েকটি শিল্পপণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও।

ব্যবসায়ীদের দাবি উপেক্ষা করায় বাজেট পাসের বিরোধিতা করছেন তারা। প্রস্তাবিত বাজেটে বর্ধিত অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) প্রত্যাহার, করপোরেট কর সবক্ষেত্রে কমানো, ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি, অ্যাপসভিত্তিক সেবার ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার, ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ দাবি এড়িয়ে যাওয়ার সমালোচনা করছেন তারা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন করে খুব বেশি করারোপ না হলেও বিদ্যমান অসামঞ্জস্য দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট বাড়ানোটা ব্যবসায়ীদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমদানিকারকদের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। যেসব খাতে ৫ শতাংশের কম ভ্যাট ছিল, সেগুলোর জন্য এখন তা অনেক বেড়ে গেল। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো অতি জরুরি ছিল। ব্যাংকের মতো অন্য খাতে করপোরেট করহার কমানোও আমাদের অন্যতম দাবি ছিল।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৭ জুন জাতীয় সংসদে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। রীতি অনুযায়ী ৩০ জুন প্রস্তাবিত বাজেট পাস হওয়ার কথা থাকলেও এবার দুদিন এগিয়ে ২৮ জুন করা হয়েছে।