ব্যাংকের নয়-ছয় সুদ এবং আরেকটি শেয়ার বিপর্যয়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৬.৫ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। চাল, তেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে এবং এ দাম অচিরেই আরও বাড়বে এমন পূর্বাভাসই দিচ্ছে বাজার।

ওদিকে ডলারের দাম টাকার বিপরীতে বাড়ছে। রফতানিকারক এবং রেমিটেন্সে প্রণোদনা দেয়ার জন্য অর্থনীতিবিদরা টাকার মূল্য আরও কমানোর জন্য জোর পরামর্শ দিচ্ছেন। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যাবে অচিরেই। সুতরাং মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কোনো সুখবর আপাতত নেই।

এমন একটা প্রেক্ষাপটে ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য ছয় শতাংশ কি যৌক্তিক সুদ? এর মানে কেউ যখন ব্যাংকে টাকা রাখবেন তার টাকা পরের বছর বাড়া দূরেই থাকুক, ঠিকও থাকবে না, পরিমাণে কমে যাবে। এ কমে যাওয়ার পরিমাণ কত শতাংশ হবে সেটা সামনের মূল্যস্ফীতি আমাদের ক্রমাগত জানাতে থাকবে। ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখে মূলত টাকার নিরাপত্তার জন্য; এ কনসেপ্ট পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য হলেও সেটি বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের ক্ষেত্রে কি আদৌ প্রযোজ্য হতে পারে?

ব্যাংকগুলোকে আমানতে সুদের হার ছয় শতাংশ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। কারণ সেটা করা গেলে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারবে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে শেয়ারবাজারে গেলে তারা খুব সহজেই বাজার থেকে বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারে। সেটি তারা করছেন না।

কেন সেটি তারা করছেন না তার অপ্রধান কারণটি আগে বলা যাক; সেটি হল, সেটি করলে তাদের কোম্পানির হিসাবপত্র জনগণের সম্মুখে উন্মোচন করতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় আসবেন তারা। সেটি করতে তাদের ভীষণ আপত্তি। আর প্রধান কারণটি হল, এ দেশে ব্যাংক থেকে নেয়া টাকা মেরে দেয়া যায় খুব সহজেই। এ দেশের অজস্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে টাকা মেরে দিয়ে বড়লোক হয়েছে।

এ দেশে যে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে, তার প্রধান অংশটাই হচ্ছে ইচ্ছাকৃত খেলাপি, যারা ঋণ নেয়ার শুরু থেকেই জানতেন এ টাকা তারা ফেরত দেবেন না, মেরে দেবেন।

অথচ এ দেশের শেয়ারবাজার ঠিকঠাক মতো চলছে না। কিছুদিন আগেও সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত খবর এসেছে শেয়ারবাজারের সংকট নিয়ে। এর পেছনে শেয়ারবাজার নিয়ে কারসাজির দায় যেমন আছে, তেমনি আছে বাজারে ভালো শেয়ারের অভাব। কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে তাদের মূলধন সংগ্রহ করলে শেয়ারবাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়তে পারত এবং সেটা এ বাজারকে স্থিতিশীল করার দিকে নিয়ে যেতে পারত ধীরে ধীরে। কিন্তু সেটা হল না।

সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত দেড় বছরে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় নয়টি সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে একবার নজিরবিহীনভাবে বিএবির সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকটি সুবিধা দিতে বাধ্য করা হয়। সুদহার এক অঙ্কে না এলেও নয়টি সুবিধার চারটিতেই ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে ২৫ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা পেয়েছে।

অথচ ব্যাংকগুলো এ সুদ হার কার্যকর না করে বারবার সময় নিয়েছে। গত বছরে দফায় দফায় পেছানোর পর ১ জানুয়ারি এ সুদহার কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও রক্ষা না করে এখন সেটি ১ এপ্রিল নিয়ে গিয়ে ঠেকানো হয়েছে। এ তারিখটাও কি ঠিক রাখবে ব্যাংকগুলো?

বাংলাদেশ পশ্চিমা অনেক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের মতো নয়, তাই এ দেশের মানুষ শুধু টাকার নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে টাকা রাখে না। এ দেশের খুব উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ব্যাংকে টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে সুদ থেকে প্রাপ্ত উপার্জনে তাদের জীবনযাপন করে। এর মধ্যে আছে অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, বিধবা এবং অনেক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ। ৬ শতাংশ সুদ করার পর এ লাখ লাখ মানুষের কী হবে সেটা সরকার কি একবারও ভেবে দেখেছে? সম্ভবত দেখেছে এবং নিশ্চিতভাবেই সেটি এ মানুষের পক্ষে যাবে না।

এপ্রিলে ৬ শতাংশ সুদ বাধ্য করা হলে অনেকের এ সংক্রান্ত আয় প্রায় অর্ধেক হয়ে যাবে। এ মানুষগুলোকে তখন বিকল্প খুঁজতে হবেই। মানুষ তখন ঝুঁকবে নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে এবং তাতে অনেকেই সর্বস্বান্ত হবেন। কিছু মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে চলতে পারছে না, বিকল্প পথ খুঁজছে- এ খবর অনেক মানুষকে ওই মানুষের জন্য নানা রকম ফাঁদ পাততে প্ররোচনা দেবে।

কিছুদিন আগে শেয়ারবাজার নামতে নামতে তলানিতে গিয়েছিল, এরপর আবার কিছু পদক্ষেপ এটাকে এক ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দিয়েছে। এ প্রবণতা দেখে ব্যাংকে আমানতকারীদের একটা বড় অংশ শেয়ারবাজারে যাবেন। শেয়ারবাজারে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা ঢুকতে থাকবে তখন শেয়ারবাজার আবার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে। সেটি আরও বহু মানুষকে সেখানে যেতে প্রলুব্ধ করবে।

আমি বিশ্বাস করি, ব্যাংকের টাকা শেয়ারবাজারে নিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করার জন্যই সুদের এ নয়-ছয়ের ফাঁদ পাতা রয়েছে। লাখ লাখ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা যখন শেয়ারবাজারে যাবে, তখন ২-৩ বছরের মাথায় আরেকটি ১৯৯৬ বা ২০১০ এসে দাঁড়াবে আমাদের সামনে।

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এ মুহূর্তে খারাপ অবস্থায় আছে এমন খবর পত্রিকায় নিয়মিত আসছে। শুধু প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি আছে। এ ছাড়া দেশের রফতানি, আমদানি, বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামাল, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ, অভ্যন্তরীণ ভোগ সবকিছু কমেছে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এক প্রচণ্ড মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

দীর্ঘ এক দশকের বেশি ক্ষমতায় থাকার সময়ে, দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ঝুঁকির মুখে ফেলে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে শুধু তার কিছু ক্রোনির স্বার্থরক্ষা করার জন্য। তাই আজ যখন ব্যাংকিং সেক্টরে নয়-ছয় করা হয়, তখন সেটাকে অস্বাভাবিক কিছু বলে আর মনে হয় না।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট