বেড়াতে গিয়ে ডুবুরি রাজ্জাক, উদ্ধার করেছেন ৫০০ মরদেহ


নিজস্ব প্রতিবেদক :
‘রাজারবাগে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে বড় ভাইয়ে কলিগের ছোট ভাই ফায়ার সার্ভিসে চাকরির পরীক্ষা দিতে এসেছিল। তার সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে বেড়াতে গিয়ে পরীক্ষা দেয়। এতে চাকরি হয়ে যায়। অনেকেই ডুবুরির বিষয়ে ভয় পায়। আসলে পানির নিচে আক্রমন ও ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। আমরা শুধু শুধু ভয় করি। আমার ২০ বছরের চাকরি জীবনে পানির নিচ থেকে ৫০০টি বেশি ডুবে যাওয়া মানুষের মরদেহ উদ্ধার করেছি।’

এভাবে ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলছিলেন, রাজশাহী সদর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি প্রধান আব্দুর রাজ্জাক। শনিবার (২২ জুলাই) রাজশাহী নগরীর সাতবাড়িয়া এলাকায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ দুই কিশোর উদ্ধার অভিযানের সময়ে আব্দুর রাজ্জাক নিজের দীর্ঘ ২০ বছরের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞাতা শেয়ার করেন ঢাকা পোস্টের সাথে।

ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি হিসেবে যোগদানের বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার ভাই পুলিশের চাকরি করে। সে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিল। আমি সেখানে বেড়াতে গিয়ে ছিলাম। আমার ভাইয়ের কলিগের ছোট ভাই ফায়ার সার্ভিসে চাকরির জন্য এসেছিল। এসময় আমাকে বলে আপনি একটু চলে আমার সাথে আজ ফায়ার সার্ভিসে লোক নিয়োগ দেবে। আমি বললাম-ফাঁকা আছি। তাহলে চলো দুই জনে বেড়িয়ে আসি। তার পরে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের গেলাম। সেখা গিয়ে দেখি, ডুবুরির জন্য লোক নিবে। তাই সাঁতার দিতে হবে।

আমি চিন্তা করলাম যে, এখানে প্রার্থী হতে কোন কাগজপত্র লাগবে কি না। এই কথা ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজনকেও জিজ্ঞাসা করি। তারা আমাকে জানায়, না আপাতত কোন কাগজপত্র লাগবে না। যদি আপনি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন। সেই ক্ষেত্রে আপনাকে সময় দেওয়া হবে। কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য। তার পরে আমি সাঁতার দেওয়া জন্য মানষিকভাবে প্রস্তিুতি নিলাম। এরপরে প্রতিটি গ্রুপে ১০ জন করে সাঁতার দেয়। ১০ জনের ওই গ্রুপে নওগাঁ জেলা থেকে আমি প্রথম হয়েছিলাম। তারপরে পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষাও ভালো হয়েছি। বিষয়গুলো পরিবারকে জানালাম। তারাও খুশি।

তিনি আরো বলেন, আমার বাড়ি নওগাঁ জেলা সদরের হরিপুর গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। নদীর ধারে আমার বেড়ে ওঠা। সাঁতার জানতাম। আর পানি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ভালো ধারণা ছিল। যার কারণে এই চাকরি টা আমার কাছে খুব সহজ মনে হয়েছে। এটি সেবাধর্মী চাকরি। মানুষের উপকার করতে পারলে আমার কাছে অনেক ভাললাগে। মানুষের স্বজনরা নদী বা পুকুরে নিখোঁজ হলে আমাদের খবর দেয়। আমরা উদ্ধার করি। অনেক সময় পানিতে নিখোঁজ মানুষকে উদ্ধারে যেতে ভয় পায় মানুষ। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন না। পানির নিচে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। আমার চোখে কোন দিন কিছু পরেনি।

তিনি আরো বলেন, চাকরিতে যোগদান ২০০৩ সালে। সেই হিসেবে চাকরির বয়স ২০ বছর। খুলনা বিভাগে ২০১০ সাল পর্যন্ত ডুবুরি পদে নিয়োজিত ছিলাম। এরপরে খুলনা থেকে বদলি হয়ে রাজশাহীতে আসি। রাজশাহীতেই কর্মরত আছি। বর্তমানে ডুবুরির লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি রাজশাহীতে। চাকরি জীবনে নদীতে থেকে কত মরদেহ উদ্ধার করেছি সেটা বলতে পারবো না। তার হিসেবে নাই। পদ্মা, যমুনা নদী ছাড়াও ছোট বড় মিলে অনেক নদী ও পুকুর রয়েছে। আমাদের ডাক পড়লে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করি। একসময় পুরো বিভাগ মিলে আমরা মাত্র তিনজন ডুবুরি ছিলাম। গেল চার বছরে আমাদরে সাথে আরো তিনজন ডুবুরি যুক্ত হয়েছে। বতমানে রাজশাহী বিভাগে ছয়জন ডুবুরি কাজ করে।

উদ্ধার অভিযানের বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের উত্তারঞ্চলে বসবাস। এই অঞ্চলে পানির ধারা আগ মুখ। দক্ষিণঞ্চলে ভৈরব নদী, ঝুলকাঠি নদী রয়েছে। এই নদীগুলোতে জোয়ার-ভাটা হয়। যান কারণে ছয় থেকে আট ঘণ্টা পরে পানি নামা উঠা করে। একসময় স্বাভাবিক পর্যায় থাকে। এই নদীগুলোতে জোয়ার আর ভাটার মাঝে একটা নিরব নদী পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত সেই সময়টায় কাজ করি। ফলে উদ্ধার অভিযানে বেগ পেতে হয় না। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানির প্রভাহ শুধু একদিকেই যেতে থাকে। যার কারণে নিরব নদীর যে সুযোগ সেটা আমরা পাই না। সেই কারণে আমাদের আস্তে আস্তে খোঁজ করে উদ্ধার অভিযান পারিচালনা করতে হয়।

ডুবুরিদের কাছে গভীরতা বড় বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে পানির স্রোত। নদীতে বেশি স্রোত হলে ডুবুরিদের কাজ করতে সমস্যা হয়। তার পরেও আমরা উন্নৎমানের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা পানির তলদেশে কাজ করি। স্বচ্ছ পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একজন সাধারণ মানুষ পানির নিচে যতটুকু দেখতে পাবে। ডুবুরিরাও ঠিক ততটুকুই দেখতে পাবে। এখানে অতিরিক্ত বা বেশি দেখার কোন সুযোগ নাই। যেহেতু নদীর পানি ঘোলা। তাই সাবধানতা অবলম্বন করে আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়।

উদ্ধার অভিযানে শনাক্তের বিষয়ে এই ডুবুরি বলেন, আমরা পানির নিচে সার্চ করে থাকি। সেটি কয়েকভাবে। লাইন সার্চ, গোল আকারের সার্চ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছাড়াও অনেক সময় পানির তলদেশে মাটিতে সুয়ে সার্চ করা হয়। পানির নিচে আক্রমন করা মতো কিছু নেই। আমরা বিভিন্ন কথা ভেবে ভয় করি। আসলে তেমন কিছু না। আমার প্রথম উদ্ধারের অভিযান ছিল খুলনায় কীর্তনখোলা নদীতে। সেখানে ১৫০ জন লোক নিয়ে একটি জাহাজ ডুবে যায়। সেই জাহারে যাত্রীদের উদ্ধারে কাজ করেছিলাম। ৪৫ জন মৃত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছিল।

উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, বড় দুর্ঘটনা হল বেশি উদ্ধার হয়। ছোট দুর্ঘটনা হলে কম। আমি একটা হিসেবে করেছিলাম ২০১৬ সালে। রাজশাহী বিভাগে এক বছরে আমি নিজে ২৬ জনের মরদেহ পানি থেকে উদ্ধার করে ছিলাম। আমার চাকরি জীবনে ২০ বছর। এই সময়ে ৫০০ জন ডুবে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করেছি।

রাজশাহী সদর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজশাহীতে ছয়জন ডুবুরি আর একজন লিডার। এই সাত জনকে নিয়ে দুইটা ইউনিট। এক ইউনিটে তিনজন করে। তারা রাজশাহী বিভাগের সব জেলায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। আমাদের এই ডুবুরিরা অনেক দক্ষ। আল্লাহর রহমতে আমাদের রাজশাহীতে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে কোন ডুবুরির মৃত্যু ঘটনা ঘটেনি। তবে ছয়মাস আগে রংপুরে ডুবুরি আব্দুল মতিনের উদ্ধার কাজের সময় মৃত্যু হয়।