‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’

দুই দিন আগেই সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে একাত্তরের শহীদ দুই বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের কথা শুনে আমার শুধুই মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বুদ্ধিজীবীসহ সব শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায় কি শুধু শহীদদের পরিবারদের? শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ আমরা কতটা মনে রেখেছি? আমরা কী শুধুই আপস করে চলছি না?

সদ্যঃপ্রয়াত বন্ধুবর রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘স্মৃতি ৭১’ এক অমূল্য গ্রন্থমালা। শহীদের আপনজনরা স্মৃতিচারণা করেছেন কী নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে! তাঁদের সবারই ‘অপরাধ’ তাঁরা বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। কেউ ছিলেন সক্রিয়ভাবে, কেউ মনমানসিকতায়। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি তাঁদের সবাইকে বলব এই গ্রন্থাবলি পাঠ করার জন্য। তাহলেই কিছুটা বোঝা যাবে কত মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে রয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এখনো সংবিধানে শব্দটি রয়েছে মূলনীতি হিসেবে; কিন্তু বাস্তবে নেই। আমরা সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সন্নিবেশিত করেছি, সেটি এখন আর বাদ দেওয়ার উপায় নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৭১-এর নির্মম অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে। কিন্তু ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বৈধতা লাভ করে। আমাদের দেশে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মিত হলে তা বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার ঔদ্ধত্য দেখানো হয়। তাকে কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয় না। অথচ ছোট ছোট সাইবার অপরাধের অভিযোগে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। অনেকেই বলছেন, ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। তাই ভাস্কর্য ভাঙা চলবে না। তবে কী মূর্তি ভাঙা জায়েজ? আমরা ভুলে যাই এ দেশে ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক আছেন, যাঁরা মূর্তিপূজা করেন। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে আমরা সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হতে পারব না। যারা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে, তাদের দেখানো প্রয়োজন বিভিন্ন মুসলিম দেশের ভাস্কর্য। ইরানের রাস্তার সঙ্গমস্থলে সে দেশের কবি-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য আমার নিজের চোখেই দেখা। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোকে আহ্বান জানাব বিভিন্ন মুসলিম দেশের ভাস্কর্যের ছবি তুলে তা প্রচার করার জন্য। কথার চেয়ে চোখে দেখার দাম অনেক বেশি।

আমরা সবাই স্বীকার করি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। মাতৃভাষার অধিকারের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলন আবার বাঙালির চেতনায় জাতীয়তাবাদের অস্তিত্বকে শাণিত করেছে। জাতীয়তাবাদ আমাদের নিয়ে গেছে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে। আর স্বাধিকারের পথ ধরেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্য আমাদের মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের একটা অনুপ্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিল। ইতিহাসের এই সত্য পাকিস্তানিরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তাই স্বাধীন বাংলাদেশকে সার্বিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস দেশের সর্বত্র তারা নিরপরাধ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করিয়েছে। আর বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে তালিকা করে তাদের পদলেহী বাঙালি পশুদের দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে জাতির সূর্যসন্তানদের।

এ কথা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে জঙ্গিবাদীরা আমাদের আবার অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট, তালেবান ও আল-কায়েদার মতো জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে দেশে চোরাগোপ্তা হামলা করছে। প্রাচীন সভ্যতার পুরাকীর্তি, জাদুঘর, গ্রন্থাগার সব ধ্বংস করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি—সব ধ্বংস করে ওরা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এই সহজ কথাটা কি আমরা বুঝতে পারি না? বাংলাদেশেও আজ আমাদের সব শুভ অর্জন ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে আমাদের আবারও সেই তমসাচ্ছন্ন যুগে ফিরিয়ে নিতে মৌলবাদী গোষ্ঠী তৎপর।

পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের রাজনীতি ও সমাজ থেকে আজ নির্বাসিত। ভিন্নমত যদি আমরা সহ্য করতে না পারি, তবে কিভাবে আমরা নিজেদের গণতন্ত্রী ও সভ্য সমাজের মানুষ বলে পরিচয় দেব? আজ সবাই মিলে অন্ধকারের অপশক্তিকে আমাদের শুভবুদ্ধি ও মানবিক চেতনার শক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ৪৯তম বার্ষিকীতে আমরা পেতে চাই আমাদের স্বপ্নের সেই বাংলাদেশকে, যার জন্য আমাদের ৩০ লাখ স্বজন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আমাদের একটাই ভরসা, বাংলাদেশ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে তার আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই, সুবর্ণ জয়ন্তীর দিকে দৃপ্ত পদে সমৃদ্ধির সোপান ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ।

কৃতজ্ঞ জাতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে স্মরণ করছে জাতির পিতাকে, আগামী বছর আমরা উদযাপন করব আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এটাই কি উপযুক্ত সময় নয় সব আপসকামিতা পরিহার করে স্পষ্ট করে আমাদের অঙ্গীকারের কথা বলা?

একাত্তরে বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ভূমিকার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আজকের বুদ্ধিজীবী ও নতুন প্রজন্ম কি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে না?

আমরা এখনো বিশ্বাস করি—‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,/ভয় নাই, ওরে ভয় নাই—/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

 

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অনারারি সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিআই)

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ