বিরল রোগ চিকিৎসায় সক্ষমতা বাড়ছে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি, রিজার্ভের উল্লম্ফন, এমডিজি বাস্তবায়নের সফলতা, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসার- অর্থনীতির এ সূচকগুলো বাংলাদেশের জন্য এখন পুরনো খবর।

শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানোয় সাফল্য, দারিদ্র্যের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামিয়ে আনা, নারী শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিয়ে রোধ, নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি, স্যানিটেশনে সফলতা- এসব নিয়েও বাংলাদেশ গর্ব করার মতো অবস্থানে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ যখন প্রতিযোগী অনেক দেশে ঈর্ষার কারণ, তখন আরো জোড়কদমে এগিয়ে আসছে আইটি সেক্টর, ইলেক্ট্রনিক পণ্য ও ওষুধ শিল্প। এগুলোতেও সক্ষমতা অর্জন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এসব এখানে বলার কারণ হলো- বাংলাদেশের কিছু স্বনামধন্য চিকিৎসকের সাফল্যগাথা।

সত্যি আমাদের শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকরা এরই মধ্যে এমন কিছু বিরল রোগের চিকিৎসা করেছেন এবং এখনো করছেন, তা ভাবলে সত্যি গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে।

আবুল বাজনদারের কথাই ভাবুন! বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি জীবনটাকেই বিভীষিকাময় বলেই ভাবতে ছিলেন। তার হাত-পায়ে শিকড়ের মতো কিছু গজিয়ে দিন দিন তা শুধু বাড়ছিলই। স্থানীয় কবিরাজ, ডাক্তার সবাইকে দেখিয়ে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন হয়তো এভাবেই তাকে সারা জীবন বাঁচতে হবে।

তার দুই হাতের তালুর চামড়া এবং ১০টি আঙুল প্রসারিত হয়ে অনেকটাই গাছের শিকড়ের মতো আকার নেয়। পায়ের আঙুল আর তালুতেও একই অবস্থা। হাত ও পায়ের নখগুলো হারিয়ে গেছে সেই শিকড়ের ভেতর। মানুষজন তাকে ডাকতে শুরু করেন ‘বৃক্ষমানব’ বলে।

২৫ বছর বয়সী যুবক আবুল বাজনদারের বাড়ি খুলনার পাইকগাছা সদরের সরল গ্রামে। ১০ বছর ধরে এই রোগে ভুগছেন আবুল। অনেক চিকিৎসককে দেখালেও ভালো হয়নি, বরং অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর সংবাদের কল্যাণে তার এই বিরল রোগের কথা বেশ জোরেশোরে প্রচার পায়। ব্যক্তি, সংগঠনের চেষ্টা আর সরকারের বদান্যতায় তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা জানান, এটি একটি বিরল রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি ‘এপিডার্মোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ নামে পরিচিত। জিনগত এবং এক ধরনের ভাইরাসের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।

রোগটি সূত্রপাতের কথা জানিয়ে আবুলের বাবা মানিক বাজনদার বলেন, আবুলের বয়স যখন ১৫ বছর, তখন তার ডান হাঁটুর নিচে আঁচিলের মতো এক ধরনের গোটা উঠতে থাকে। পরে দুহাতের কনুই পর্যন্ত এবং দুপায়ের হাঁটু পর্যন্ত আঁচিলে ভরে যায়। খুলনায় হোমিও চিকিৎসাও করান তারা। কিন্তু শিকড় গজানো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।

পরে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় আবুলকে। সেখানকার চিকিৎসকেরা একপর্যায়ে তাকে আরও উন্নত চিকিৎসা নিতে বলেন। পরে অনকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে টাকা তুলে দুদফায় ভারতের কলকাতায় চিকিৎসাও করান তাকে।

হাত ও পায়ে গজানো শিকড়কে খুব ভারী মনে হতো আবুলের। তিনি বলেন, এগুলো থেকে মাঝে মাঝে উৎকট গন্ধও তৈরি হয়। খাওয়া থেকে শুরু করে কোনো কাজই তিনি নিজে করতে পারেন না।

আট ভাইবোনের মধ্যে আবুল ষষ্ঠ। ২০১১ সালে গড়ইখালী গ্রামের হালিমা খাতুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের তিন বছরের একটি শিশুকন্যা আছে।

আবুল হোসেন জানান, তিনি আগে ভ্যান গাড়ি চালাতেন কিন্তু  হাতের আঙুল থেকে যখন এই শেকড় বের হতে থাকে, তখন থেকে আর কোনো কাজ করতে পারেন না।

হাসপাতালে ভর্তির পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকরা তাকে নিবিড় পরিচর্যার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন।

বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ড. সামন্ত লাল সেন জানান, তারা একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগীর হাত ও পাকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন।

ড. সেন জানান, তার জানামতে এ পর্যন্ত বিশ্বে এর আগে মাত্র দুজন রোগীর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড আছে। এদের একজন ইন্দোনেশিয়ায় এবং অপরজন রুমানিয়ায়। আবুল হোসেন বিশ্বে তৃতীয় ও বাংলাদেশে প্রথম রোগী।

ডা. সেন জানান, তারা আবুল হোসেনের চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ বহন করবেন। এমনকি আবুল হোসেন ও তার মায়ের খাওয়া-দাওয়া ও থাকার খরচও দেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

আশার কথা হচ্ছে, চিকিৎসার জন্য ভারত থেকে আবুল হোসেনকে ফিরিয়ে দিলেও ঢামেকের চিকিৎসকরা এখন আবুল বাজনদারকে প্রায় সুস্থ করেই ফেলেছেন। বিরল রোগের চিকিৎসায় আমাদের চিকিৎসকদের এ এক বিরাট সাফল্য।

বিথীর বিরল রোগ : বিরল রোগ ওয়েরউল্ফ সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন টাঙ্গাইল নাগরপুরের বিথী আক্তার। ১২ বছর বয়সী এই কিশোরী বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন।

বিথীর বাবা আবদুর রাজ্জাক জানান, মুখমণ্ডল, হাত ও পায়ে ঘন কালো বর্ণের অস্বাভাবিক বড় লোম। বুকে-পিঠেসহ দেহের অন্যত্রও একই অবস্থা বলে জানান তার বাবা ।

বিথীর মা বিউটি আক্তার জানান, ১১ বছর বয়স থেকে বিথীর স্তনের আকৃতি অস্বাভাবিক আকারে বড় । তার সামনের উপরের দাঁতের রঙও বিবর্ণ। দেখতে মাংসপিণ্ডের মতো।

বিথীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেন জানান, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেছে বিশ্বে এমন দু-তিনটি ঘটনা ঘটেছে।

বিএসএমএমইউ’র আরেক হরমোন বিশেষজ্ঞ বিথীকে দেখে বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে- এটা ওয়েরউল্ফ সিনড্রোম। এতে আক্রান্তকে হাইপারট্রাইকোসিস রোগী বলা হয়।

আক্রান্তদের মুখমণ্ডল ও দেহে অস্বাভাবিক লোম দেখা দেয়। মূলত জিনের পরিবর্তন হওয়ার কারণে এমন ঘন লোম গজায়। এই রোগের এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা নেই। তবে বিথী প্রকৃতই ওয়েরউল্ফ সিনড্রোমে আক্রান্ত কিনা- শতভাগ নিশ্চিত নন তিনি।

আবার কিছু চিকিৎসক বলেছেন, চিকিৎসাশাস্ত্রে এ পরিস্থিতিকে হার্সুটিজম বলা হয়, এটাও হাইপারট্রাইকোসিসের রূপই। যার প্রভাবে মেয়েদের ঠোঁটের উপরি ভাগে, গালে, চিবুকে, বুকে, স্তনে, তলপেটে, নিতম্বে অথবা কুঁচকিতে শক্ত-কালো চুল গজায়।

এ রোগে বাড়তি চুলের পাশাপাশি মাথায় টাক, পুরুষালি পেশি গঠন, গভীর কণ্ঠস্বর, ব্রণ, মাসিক বন্ধ, স্থূলতা, বন্ধ্যাত্ব, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকতে পারে।

রোগের নাম যাই হোক, চিকিৎসকদের কথায় ভরসা করে বিথীর বাবা বলেন, ‘ডাক্তাররা বলছে, ভাল হইব, কিন্তু অনেক টেকা লাগব। তিনি গরিব মানুষ, কই পাবেন এতো টাকা। তাই তিনি আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান তথা সরকারের কাছে।

এরই মধ্যে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি ওয়ালটনের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে তার চিকিৎসার সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। আবুল বাজনদারের মতো তারও চিকিৎসায় সরকার ব্যয় বহন করবে।

বিথীর বাবার মতো আমরাও আশাবাদী বিথী বিরল রোগ থেকে সেরে উঠবে। শুধু বাংলাদেশ সারাবিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানেও আমাদের চিকিৎসকদের সাফল্যগাথা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

বৃদ্ধশিশু বায়েজিদ: সন্তান জন্মের পর চার বছর ধরেই মা তৃপ্তি খাতুন ও বাবা লাভলু সিকদার তাদের সন্তানকে নিয়ে যেন যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন। জন্মের পর থেকেই একমাত্র সন্তান বায়েজিদকে নিয়ে তারা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন।

বিরল রোগ ‘প্রোজেরিয়া’ আক্রান্ত শিশু বায়েজিদ। জন্মের পর থেকেই শিশুটির চেহারা অন্য দশ শিশুর মতো নয়। চেহারায় তার বৃদ্ধের ছাপ স্পষ্ট। আমাদের গণমাধ্যম তাকে ‘বৃদ্ধ-শিশু’ বলে সংবাদ প্রচার করে। নজরে আসে সরকারেরও। তাই শিশুটিকে নিয়ে তার বাবা-মা নিজ জেলা মাগুরা থেকে ঢাকায় এনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, বিরল রোগ ‘প্রোজেরিয়া’ আক্রান্ত শিশু বায়েজিদ। তিনি বলেন, বায়েজিদের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। সবার কাছে দোয়া চাই যেন আবুল বাজনদারের মতো আমরা এক্ষেত্রেও সফল হই।

এরই মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন, বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন, ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ, শিশু বিভাগের  সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা, শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার, এন্ডোক্রাইনলোজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল আনসারী, প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মালিহা হোসেন এবং বার্ন ইউনিটের ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ডা. মো. সাজ্জাদ খোন্দকার।

বায়েজিদের রোগটিকে জেনেটিক ডিজঅর্ডার হিসেবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে মেডিক্যাল বোর্ড। আর সেজন্য রক্ত, এক্স-রে, কিডনি, কার্ডিয়াক, ত্বকের বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষাসহ প্রায় ২১ ধরনের পরীক্ষা শুরু হয়েছে শিশু বায়েজিদের।

ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, এ ধরনের রোগী আমরা আগে আর দেখিনি। আমরা এখনো জানি না শিশুটির হরমোনাল, কার্ডিয়াক বা জেনেটিক সমস্যা রয়েছে কিনা।

তবে এটুকু বলতে পারি, ছেলেটি যেহেতু ভর্তি হয়েছে, আমাদের ‘বেস্ট পসিবল ট্রিটমেন্ট’ সে পাবে। তাকে সব ধরনের ভালো চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যা কিছু করার আমরা করব। বৃক্ষমানব আবুল বাজনদারের মতো এই শিশুটির বেলায়ও আমরা আমাদের বেস্ট ট্রাই করব।

শিশুটির বাবা রং মিস্ত্রি লাভলু সিকদার বলেন, আমাদের একটাই ছেলে। চার বছরের বায়েজিদ। জন্মের পর থেকেই বুঝতে পারি সন্তানটি আর দশটি সাধারণ শিশুর মতো স্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মায়নি। শিশুটি জন্মগ্রহণ করে শরীরে ঝোলানো চামড়া নিয়ে।

মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে চিকিৎসকরা কিছু বুঝতে পারেন না। পরে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে তারা যেতে বলেন। সেই হাসপাতালেও ডাক্তাররা কিছু বলতে পারলেন না। পরে বাড়ি চলে এলাম। তার পর একে-ওকে অনেক দেখিয়েছি, কিন্তু ফল পাইনি।

লাভলু সিকদার বলেন, এই চার বছরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি সর্বস্বান্ত হয়েছি। জমি বিক্রি করেছি, প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসা করানোর মতো আর টাকা নেই হাতে। শেষমেষ অনেকের পরামর্শে ঢাকা মেডি্যোল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করলাম।

ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, বৃক্ষমানব আবুল বাজনদারের মতো এ শিশুটির সব ধরনের খরচও  সরকার বহন করবে। তিনি আরো জানান, এ ধরনের রোগ ও রোগী আমাদের কাছে প্রথম। এটি কী রোগ, কী সমস্যা সে বিষয়ে আমরা কিছুই বুঝিনি। আমরা চিকিৎসার শুরুতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। তার মুখের বাড়তি মাংসগুলো কমানোর চেষ্টা করব। স্বাভাবিকভাবেই এ চিকিৎসায় একটু সময় লাগবে। আর এ চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার সরকারিভাবে বহন করা হবে।

চিকিৎসদের মতো আমরাও আশাবাদী এসব বিরল রোগ চিকিৎসায় তারা সার্বিকভাবে সফল হবেন। বিরল রোগ চিকিৎসায় আমাদের চিকিৎসকরাও যে সক্ষম, এটা জানুক বিশ্ব।

 

সূত্র: রাইজিংবিডি