বিপিএল জুয়ায় ভাসছে রাজশাহী নগরী: মোবাইলেই হচ্ছে লেনদেন

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভয়ংকর জুয়ার আসর বসছে রাজশাহীতে। আইপিএল থেকে শুরু করে এবার বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগকে (বিপিএল) কেন্দ্র করে নগরীর অন্তত ১০টি পয়েন্টে বসছে এসব জুয়ার আসর। স্থানীয়ভাবে যেগুলো বিপিএল জুয়ার বোর্ড নামে ডাকা হচ্ছে। আবার ফোনে ফোনেও চলছে জুয়ার টাকার লেনদেন।

 

  • বাজি খেলার নামে এসব বোর্ডে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে। একটি শ্রেণির লোকের এখন আসল পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ জুয়া। এতে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসকসহ নানা পেশার মানুষও জড়িয়ে পড়ছে বাজির জুয়ায়। সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই। জুয়ার টাকা দিতে না পারায় ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনাও।   

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর শালবাগান, লক্ষীপুর সাহেব বাজার এলাকায় বসছে সর্ববৃহৎ জুয়ার বোর্ড। শালবাগান এলাকার কমল ও সুমন নামের দুই ব্যক্তি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জুয়ার আসর বসাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন আরো অন্তত ৩০ জন।

 

বিপিএলে কোন দল জিতবে, কোন দল কত রানে জিতবে বা হারবে, কত রান করবে, কত রানের নিচে থাকবে এসব নানা বিষয়ে  অধিকাংশ ক্ষেত্রে মোবাইলেই বাজিতে মেতে উঠছেন জুয়াড়ীরা। আর জুয়াড়িদের দল কেনাবেচায় মাঝে মিডিয়া হয়েও কাজ করছেন অনেকে। অন্যরা তাদের নিকট থেকে দর জেনে বাজিতে টাকা লাগাচ্ছেন।

 

কখনো কখনো একজন বাজিগরই ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্তও বাজি ধরছেন তার সমর্থনকারী দলের পক্ষে। শালবাগান বোর্ডে অন্তত ৫০০ বাজিগর বাজি ধরছেন তাদের সমর্থনকৃত দলের পক্ষে। কেউ সরাসরি ওই বোর্ডে গিয়ে আবার কেউ শুধুমাত্র মোবাইল ফোনে কথা বলে জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন।

 

  • ফলে প্রতি রাতেই এই আসরে অন্তত কোটি টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে। আর মাঝখানে মধ্যস্ততা করার জন্য একটি অংশ ভাগ পাচ্ছেন মিডিয়াম্যান হিসেবে পরিচিত পাওয়া সুমন ও কমলসহ তাদের লোকজন।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জুয়াড়ি সিল্কসিটি নিউজকে নিশ্চিত করেন, রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থানে সবমিলিয়ে ১০টি পয়েন্টে আইপিএলকে কেন্দ্র করে জুয়ার আসর বসছে। আইপিএএল থেকে শুরু করে গত টি-২০ বিশ্বকাপ ও ওয়ান্ডে বিশ্বকাপেও এই আসর বসেছিল।

 

সবমিলিয়ে গত ৫-৬ বছর ধরেই এসব জুয়ার আসর বসছে। তবে আর ক্রমেই ক্রিকেট জুয়ায় মেতে উঠছে নগরীর এক শ্রেণির জুয়াড়িরা। জুয়ায় টাকা খুইয়ে অনেকে নিজের সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসছেন।

 

  • টাকার অভাবে কেউ কেউ দামি মোবাইল, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, স্ত্রীর স্বর্ণের গহনাসহ নামি-দামি জিনিসপত্র বন্ধক রেখেও টাকা সংগ্রহ করছেন। আবার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা জুয়ার পাকার সংগ্রহ করতে ধার-দেনায় জড়িয়ে পড়াসহ বাবার পকেট কাটছে অনেকেই।

 

নগরীর শলাবাগান এলাকার একাধিক সূত্র নিশ্চিত সিল্কসিটি নিউজকে করেছে, এ এলাকায় জুয়ার টাকার জোগান দিতে কয়েকজন সুদ ব্যবসায়ীও রয়েছেন। যাদের নিকট থেকে সুদের টাকা নিয়ে জুয়াড়িরা জুয়ার আসরে জমা দিচ্ছে। এসব সুদের টাকাও দেওয়া হচ্ছে উচ্চ হারে।

 

  • নগরীর আসলাম উদ্দিন নামের এক জুয়াড়ি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, তিনি গত টি-২০ বিশ্বকাপে সালবাগান এলাকার সুমনের নিকট থেকে ১ লাখ টাকা সুদের ওপরে নেন। এর পর ওই টাকার সুদসহ তাকে ফেরত দিতে হয়েছে আড়াই লাখ টাকা।

 

গত দুই বছর আগে আইপিএলের সময় জুয়ায় এক রাতে ২০ লাখ টাকা হেরে ওই রাতেই কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নগরীর হাজি ভবন নামের মেসে ওই ছাত্র আত্মহত্যা করেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

 

  • সূত্র মতে, নগরীর লক্ষীপুরে লিটন নামের এক ব্যক্তিও জুয়ার আসর বসান। তার আসরেও প্রতিদিন শতাধিক ব্যক্তি জুয়া খেলছে। এখানেও মূল আসর বসছে মোবাইলে। মোবাইলের মাধ্যমেই জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাঝখানে কমিশন আদায় করছেন লিটন।

 

এর বাইরে নগরীর সাহেব বাজার, বাসটার্মিনাল, কাজলা, কাশিয়াডাঙ্গাসহ অন্তত ১০টি পয়েন্টে বসছে জুয়ার আসর। এসব আসর থেকে স্থানীয় থানা পুলিশ নিয়মিত মাশোহারা আদায় করছে বলেও জানিয়েছেন জুয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিপিএল জুয়ার অধিকাংশ টাকা লেনদেন হচ্ছে নগরীর বর্ণালীর মোড়ের একটি চা-স্টলেও। এখানে চা-সিগারেট পান করতে এসে অধিকাংশ জুয়াড়ি জুয়ার টাকা লেনদেন করছেন কৌশলে বা প্রকাশ্যে।

 

সূত্র মতে, বিপিএলকে কেন্দ্র করে নগরীতে এখন জুয়ার আসর রমরমা অবস্থা বিরাজ করছে। এটি এখন কারো কারো ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আবার বাড়ি থেকে বাবা-মায়ের নিকট থেকে নানা ছল-চাতুরি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে আইপিএল জুয়ায়। যাদের পাল্লায় ভারি হচ্ছে প্রতিদিন।

 

  • এর বাইরে নগরীর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এমনকি  রামেক হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, ভ্যানচালক, দিনমজুর, হোটেল কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি পেশার মানুষরা জড়িয়ে পড়ছেন বিএপিএল জুয়ায়।

 

নগরীতে বিপিএলের নামে জুয়া চলার বিষয়টি স্বীকার করেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখ্যপাত্র ইফতে খায়ের আলম। তিনি বলেন, সাধারণত এসব জুয়াগুলো হচ্ছে মোবাইলে। তাই কাউকে ধরা যাচ্ছে না। জুয়ার টাকার ভাগও হচ্ছে মোবাইলে। ফলে ক্রমেই জুয়া ছড়িয়ে পড়ছে নগরীতে। তবে পুলিশ সচেষ্ট আছে জুয়ার আসর যেন কেউ না বসাতে পারে।

 

তিনি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোবাইলের মাধ্যমে এসব জুয়া খেলা হচ্ছে বলে শুনেছি। তবে এ নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে।’

 

স/আর