বাঘা পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

কখনও কাজ ছাড়াই বিল তুলে নেয়া, কখনও পৌরসভার টাকা রাজস্ব ফান্ডে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ, কখনও ঠিকাদারের নামে ভুয়া বিল উত্তোলন, কখনও বৈদ্যুতিক মালামালের টেন্ডার করে মালামাল ছাড়া অর্থ পরিশোধ, কখনওবা অর্থের বিনিময়ে অবৈধ নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা; এমন নানাবিধ অভিযোগে মেয়াদের পুরো সময়টাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছেন রাজশাহীর বাঘা পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক, তার সহযোগী পৌর প্যানেল মেয়র শাহিনুর রহমান পিন্টু এবং প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম।

এত অপকর্ম, এত দুর্নীতির পরও মেয়র বহালতবিয়তে থাকায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, আওয়ামী সরকারের সময় জামায়াত সমর্থিত মেয়র কিভাবে ’ডোন্ট কেয়ার নো পার্সন’ মুডে সীমাহীন দুর্নীতি করে যাচ্ছেন? তার আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা কে? প্রশাসন কেন নীরব? এমন হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নাগরিকদের মাঝে । অবস্থাটা এমনই, যেন বাঘা পৌর মেয়র নিজেই সংবিধান।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (১৪ জুন) পৌরসভার দুটি হাট ডাকের টাকা পৌর ফান্ডে জমা না দেয়া এবং ১০ পদে নিয়োগ পরীক্ষার আগেই প্রার্থী নির্ধারণের তালিকা প্রকাশ পাওয়ায় তার সীমাহীন দুর্নীতির ভয়াবহতার চিত্র আরো ভয়াবহভাবে ফুটে ওঠে।

জানা যায়, পৌরসভার দুটি হাট (বাঘা ও চণ্ডীপুর) মেয়র নিজের ইচ্ছামতো এক মাস এক মাস করে ইজারা দিচ্ছেন। হাট-ঘাটের ডাককৃত অর্থ ওই দিনই পৌর রাজস্ব ফান্ডে জমা দেয়ার বিধান থাকলেও তিনি ডাককৃত সমুদয় অর্থ (১২ লাখ ৪০ হাজার) পৌর রাজস্ব ফান্ডে জমা দেননি। এ নিয়ে এলাকায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এর মাত্র দুদিন আগে ১২ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে প্রকল্পের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার করে টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগে অভিযান চালায়। অভিযানে প্রকল্পের রাস্তা দেখতে চাইলে তিনি দুদক টিমকে সাবেক মেয়রের আমলে হওয়া রাস্তা দেখান। এ সময় স্থানীয় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে দুদক কর্মকর্তাদের বলেন, এই রাস্তা সাবেক মেয়রের আমলের।

জানা যায়, পৌরসভায় ১০টি পদে জনবল বৃদ্ধির জন্য মেয়র রাজ্জাক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্মারক নাম্বার-৪৬.০০.০০০০.০৬৩.১১.০২৩.১৯.১৮৯ প্রথমবার নিয়োগ দানের অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে নিয়োগদানে ব্যর্থ হন মেয়র। পুনরায় তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সময় বৃদ্ধি করে দ্বিতীয়বার পত্র প্রেরণ করে সংশি­ষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের জন্য দ্বিতীয়বারের নিয়োগ পরীক্ষাও বাতিল করে মন্ত্রণালয়। নিয়োগদানে ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার সময় বৃদ্ধির আবেদন করেন মেয়র। ফলে মেয়রের সময় বৃদ্ধির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট তৃতীয় ধাপে শেষবারের মতো নিয়োগ প্রদানের অনুমতি দেয় সংশি­ষ্ট কর্তপক্ষ। কিন্তু এবারও অনিয়ম থাকায় নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে মন্ত্রনালয়।

কারণ, এর আগে ২৭ অক্টোবর পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে জনবল নিয়োগ, রাজস্বের অর্থ তছরুপ, হাট-বাজার ইজারার টাকা পৌর তহবিলে জমা না করাসহ সরকারি অনুদান ও বিভিন্ন খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপের লিখিত অভিযোগ জমা দেন। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় গত ২৮ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের পৌর শাখা-১-এর উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে দুর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দেন উপসচিব আবুজাফর রিপনকে। সর্বশেষ গত ৭ জুন নিয়োগ পরীক্ষার দিন নির্ধারিত হয়। সে মোতাবেক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় মন্ত্রণালয়ের আদেশ। এক নিয়োগে এত নাটকীয়তায় চাকরিপ্রত্যাশীরাও হচ্ছেন হয়রানির শিকার।

বাঘা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাঘা পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক বেপরোয়াভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে চলেছেন। এর আগে তিনি মেয়রের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করায় তার ১১ মাসের বেতন-ভাতা আটকে রাখা হয়েছিল। তার ওয়ার্ড এলাকায় সব ধরনের উন্নয়ন বরাদ্দ ও সেবা কার্যক্রম ছিল বন্ধ। পৌরসভার হাট-বাজার ইজারা বাবদ আহরিত ১ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং পৌর মার্কেট নির্মাণে টেন্ডারপত্র বিক্রি বাবদ পাওয়া ৯৬ লাখ টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না করে মেয়র আত্মসাৎ করেছেন। এসব খাতের ভ্যাট ও আয়কর বাবদ টাকা মেয়র অদ্যাবধি সরকারি রাজস্ব খাতে জমা করেননি, যা গুরুতর অপরাধের শামিল। পৌর

তিনি আরো বলেন, এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ১৫ লাখ টাকা পৌর তহবিল থেকে উত্তোলন ও ব্যয় দেখানো হলেও কোথাও কোনো কাজ করা হয়নি। একই ভাবে জন্মনিবন্ধন থেকে পাওয়া অথের্র একটি অংশ সরকারের রাজস্ব খাতে জমা করার নিয়ম থাকলেও পৌর মেয়র এখন পর্যন্ত এক টাকাও জমা দেননি।

ওই কাউন্সিলর আরো বলেন, বর্তমানে বাঘা পৌরসভায় ১৮ জন স্থায়ী ও ১২ জন অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। পৌর তহবিলে টাকা না থাকায় বেতন-ভাতা নিয়মিত দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া গত এক বছর পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ তহবিলেও কোনো টাকা জমা হয়নি। পৌর মেয়র বিভিন্নজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নিয়ে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালিয়েছেন। যেখানে পৌরসভার বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থাভাবে নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না, সেখানে আরো ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে; সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম।

এর আগে মেয়র আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জেলা প্রশাসকসহ বেশ কয়েকটি দফতরে অভিযোগ করেন সচেতন নাগরিক ফোরামের নেতা সৈকত মাহামুদ। তিনি তার অভিযোগে উলে­খ করেন, ২০১৮-২০১৯ এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পৌরসভার চন্ডিপুর গরুহাট মেয়র তার নিজস্ব ঠিকাদারকে ১ কোটি ৩১ লাখ টাকায় ইজারা দেন। এই ইজারা দেয়ার পর এখনও ৬০ লাখ টাকা অনাদায়ী রয়েছে এবং ইজারা বাবদ এখন পর্যন্ত আয়কর ভ্যাট ব্যাংকে জমা হয়নি। অনুরূপভাবে বাঘার হাট দুইবারে ৮০ লাখ টাকায় ইজারা দেয়া হলেও অনাদায়ী রয়েছে ৩০ লাখ টাকা।

অন্যদিকে বাঘা বাজারে পৌরসভার অর্থায়নে পৌর মার্কেট নির্মাণের পর ২৩টি দোকান বাবদ ১ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেলেও ব্যাংকে জমা হয়েছে মাত্র ৬০ লাখ টাকা। বাকি ৪০ লাখ টাকা মেয়র আব্দুর রাজ্জাক তার নিজ প্রয়োজনে খরচ করেন বলে অভিযোগে উল্লে­খ করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান পৌরসভার কর্মচারীদের ৪ মাসের বেতন বাকিসহ বিবিধ সমস্যা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে।

বাঘা সুনাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, জামায়াত-বিএনপিপন্থী মেয়রের শক্তির উৎস কী? যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, সেখানে এই মেয়র তার সহযোগী প্যানেল মেয়রকে নিয়ে কিভাবে এত দুর্নীতি করে টিকে আছেন? নিয়োগ সম্পর্কে নাগরিক সমাজরে পক্ষ থেকে বলা হয়, যেখানে বর্তমানে পৌরসভার বেহাল দশা, সেখানে নতুন করে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১০টি পদে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্য নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ বিষয়ে মেয়র রাজ্জাকের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও মুঠোফোনে না পাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

সূত্র: সকালের সময়