বাংলা নববর্ষ উদযাপন বোনাস হোক সবার জন্য

বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। হাজারো সম্ভনার দেশ বাংলাদেশ। এই দেশে শতাধিক সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পসমূহ মানবতার কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে এ কথা অনস্বীকার্য। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হলেও আমাদের দেশের মানুষের দুই ধরনের সংসার বিদ্যমান। একটি নিম্নমধ্যম আয়ের রাষ্ট্রীয় সংসার। অন্যটি নিম্নমধ্যমশ্রেণীর বা তার নিচের দিকের মানুষের পারিবারিক সংসার। এই দুটি সংসারের মানুষই শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপনের জন্য নানামুখি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

 

এসব সংসারের কর্তাব্যক্তি ও সদস্যবৃন্দ পরিবারের ব্যয়ভার  সামলানোর জন্য কতগুলো নীতি অনুসরণ করেন। অনুসৃত এসব নীতির মধ্যে কিছু সংখ্যক অদ্ভ্যুতভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন একজন নিম্নশ্রেণীর আয়ের মানুষ ধরে নিলাম যার আয়ের উৎস একটি তিন চাকা বিশিষ্ট ভ্যানগাড়ি। শোবার ঘর নেই। আছে খড়ের বেড়া দিয়ে নির্মিত অস্থায়ী আবাসস্থল।

 

অন্যদিকে নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ যাদের আয়ের উৎস সরকারী চাকুরী। কারো ব্যবস্যা। আবার কারো অন্য কোন অভিজাত পেশা। যাঁদের বাড়ি গুলশান, বনানী, বারিধাারার মত অভিজাত শহর এলাকায়। এই দু’শ্রেণীর মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ মিল হলো আয়ের মাত্রা যেটিই হোক না কেন তাদের কেনাকাটার জায়গা একই। একজন দরিদ্র মানুষ যে বাজার থেকে মাছ কেনেন, সবজি-তরকারী কেনেন. চাউল-ডাউল কেনেন উচ্চ আয়ের ওই সাহেবরাও মাছসহ অন্যান্য দ্রবাদি কেনাকাটা করেন সেই একই বাজার থেকে। একই হারে দাম দিয়ে। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ উচ্চ আয়ের মানুষের হাকা দামের সাথে তাল মেলাতে পারুক বা না পারুক তা দেখবার বিবেক কারো নেই। জীবন সংগ্রামের এ বাজারে সবাই সমান।

 
কিন্তু সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য বছরে যদি দুটি বা তিনটি উৎসব ভাতা সরকার কর্তৃক ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হয় তবে নিম্নশ্রেণীর মানুষ কোনদিনও এসবের সুফল পাবে না। পাবেন যাঁদের আলিশান বাড়ি আছে। অথবা আলিশান বাড়িতে যারা ভাড়া থাকেন। সব রকমের বোনাস তাদের জন্য যারা ভ্যানে চড়ে নয় বিএমডব্লিও বা তার চেয়ে বেশী দামি গাড়িতে করে  মাছ কিনতে আসে। নিম্ন আয়ের পরিবারের কর্তাকে সরকারকে কর দিয়ে নিজেদের বাজেট তৈরী করতে হয়। তাদেরকে সাহায্য বা অনুদান পাঠাবার জন্য কেউ হাত বাড়িয়ে দেয় না। প্রত্যক্ষ কর বাদে অন্যান্য পরোক্ষ করের দায়ও তাদের মেটাতে হয়। সব দায় মিটিয়ে সামর্থ্য না থাকলে নিত্যদিনের বাজেট কাট করে সংসার চালিয়ে নিতে হয়। পরিবারে একজন কর্তার সংগ্রামী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

 
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সংসার পরিচালকদের সংগ্রামের কষ্ট এত গভীর হয় না। জনগণের কল্যাণ হোক বা না হোক, দেশের উন্নয়ন কাজ হোক বা না হোক তাদের কোন ক্ষতি নেই। চিন্তা নেই। কারো কাছে জবাব দিহিতার ব্যাপার নেই। সাধারণ জনগণের করের টাকায় বিলাশী জীবন যাপননে কোন বাধা নেই। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের অভাব মেটানোর যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটে নির্বাচনে জয় পরাজয়ের মাধ্যমে। নির্বাচনে জিতে গেলে একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত দেশের মানুষের অভাব মেটাতে না পারলেও কারো পোষ্ট পজিশন হারিয়ে যায় না।

 

জীবনযুদ্ধের এ সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে সবাই সপুষ্ট হয়। কেউ অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুর মুখে পতিত হয় না। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ নিম্নবিত্তদের মনে কষ্ট রেখে বড়বড় সাহেবদের নবববর্ষ উদ্যাপন ভাতা প্রদান করে বাংলা নববর্ষকে কোনভাবে কী সার্বজনীন উৎসবে পরিনত করা যাবে? এ পক্রিয়ায় কী বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে পরিনত করা সম্ভব হবে? সরকারী চাকুরীজীবিদের পনের থেকে বিশ শতাংশ মানুষের হাতে উৎসব ভাতা তুলে দিয়ে অন্যান্য আশি শতাংশ মানুষের মুখে কি হাসি ফুটবে?

 
এর জন্য করনীয় হলো দেশের স্বল্প সংখ্যক সরকারী চাকুরীজীবি, স্বল্প সংখ্যক বেসরকারী চাকুরীজীবি এবং বাঁকি অন্যান্যরা যারা যেরকম সামাজিক নিরাপত্তা সেবাভোগি আছেন তাদের প্রাপ্য হারে বাংলা নববর্ষ বোনাস প্রদান করলে এ উৎসব সার্বজনীন ও সুখময় উৎসব হতে পারে বলে আমি মনে করি।

 

এ লক্ষে জরুরী বিষয় হলো সরকার কর্তৃক অনুমোদিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি বাস্তবধর্মী ‘সার্ভিস রুল’ তৈরি করা যেখানে সরকারে ইচ্ছা-অনিচ্ছার সহজ প্রতিফলন ঘটবে। যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হবে। কর্মীর উৎপাদনশীলতা বাড়বে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হবে। একটি ন্যায় ভিত্তিক শান্তির সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। কেননা দেশ গড়তে শুধু সরকারী কর্মকর্তাদের অবদান নয় বরং বেসরকারী খাতে কর্মরত মানুষের রয়েছে অমূল্য শ্রম। রয়েছে ঘরে বাহিরে অন্যান্য আনপেইড মানুষের ডেডিকেশন। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে, অবকাঠামোগত উন্নয়নে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরীতে, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী ও অন্যান্য খাতের মানুষ অতন্দ্র প্রহরীর মত কাজ করে যাচ্ছে।

 
পৃথিবীর কোন দেশে নববর্ষ ভাতা প্রদানের কী সংস্কৃতি আছে তা আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানা আছে যে, একটি জাতি তার কর্মঠ অথবা অকর্মঠ নাগরিকদের দিয়েই তাদের ইতিহহাস লিখবে। তাদের কাজ মোতাবেক পরিচিতি পাবে। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে পৃথিবীতে ‘সমস্যা’ ও ‘সমাধান’ দ’ুটো শব্দ একসাথে থাকবে তার বিষয়ে। বীর বাঙালি হিসেবে আমারা সমস্যা না সমাধানের অংশিদার হবো সেটি আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মাানুষের দুটি হাতে মানবতার কল্যাণে সম্পাদিত কাজ স্বগীয় সদালাপ থেকে অনেক বেশী উত্তম।

 

আজকে আমার এ লিখার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমারা আমাদের দেশের মানুষের জন্য হয়তো ভবিষ্যৎ প্রস্তুত করতে পারবো না সত্য কিন্তু আমারা আমার দেশের মানুষকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারব এই কৌশল নির্ধারণ করতে। এই মর্মে এখানে শিভ খেরার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সম্মানের সাথে বসবাস’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে একটি গল্প বলা যাক, একজন অতি বৃদ্ধলোক তার বাস্তুভিটায় একটি গাছের চারা রোপন করছেন। পাশ দিয়ে একজন জোয়ান লোক হেঁটে যাবার সময় বৃদ্ধকে দেখে বললো, এই যে বৃদ্ধ বাবা, আপনি আপনার বয়সের দিকে তাকিয়েছেন? আপনি আর কয়দিন এ পৃথিবীতে বাঁচবেন?

 

যে বৃক্ষের চারা রোপন করছেন তা হতে যে ফল হবে সেটি কী আপনি খেতে পারবেন? বৃদ্ধ লোকটি মাথা উচু করে লোকটিকে বললেন, আমি আমার এই জীবদ্দশায় যতগুলো বৃক্ষের ফল খেয়েছি তার সবগুলো কি আমি লাগিয়েছিলাম? নিশ্চয় নয়! ওই গাছগুলো যদি আমি না লাগিয়ে থাকি তবে অবশ্যই আমার পূর্বপুরুষেরা আমাদের জন্য তৈরী করে গেছেন! তাদের মত আমরা কী আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের অভিভাবক হতে পারি না?

 
এই গল্পের সারমর্ম থেকে আমি আমাদের দেশের ষোল কোটি মানুষকে যদি একসাথে কল্পনা করি এবং এও কল্পনা করি যে, দেশের সরকারী চাকুরীজীবিদের সাথে বিশ শতাংশ পরিবার এবং বেসরকারী চাকুরীজীবিদের সাথে চল্লিশ শতাংশ পরিবার আর বাঁকি পরিবার কোন চাকুরীরি সাথে সম্পর্কিত না হয়ে জীবন ও জীবিকা পার কারছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের জিজ্ঞাসা হলো পহেলা বৈশাখে সরকারের মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে নববর্ষের কারণে আনন্দ উৎসবে ভরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে ? বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বাঙালির ঘরে কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে?

 

তাই আজকের বাঙালি সমাজ ও ভবিষ্যৎ বাঙালি সমাজের মানুষের কথা ভেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমাদের আকূল আবেদন এই যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জাতির পিতার কন্যা। আপনার হাতে এদেশে বুক থেকে অতিদারিদ্র নামক অভিশাপটি মানুষের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসতে শুরু করেছে। এদেশে আর কোন মানুষ অভুক্ত থাকে না। আপনার সময়পোযোগি সিদ্ধান্তের কারণে দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ স্বাক্ষরতার সম্মান অর্জন করেছে।

 

আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ আজ সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হয়েছে। মহাকাশে নভোযান পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। দেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা সেতু তৈরী হচ্ছে। মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আপনার শাষণ আমলে দেশে একশ’টির বেশী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে উৎসব আমেজের সংস্কৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনার অদম্য প্রতিভার কারণে ঢাকা মেট্রো রেলের মতে মেগা প্রজেক্টের পথে এগিয়েছে।

 

উন্নয়নের এ গতিধারা অব্যাহত রাখতে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখের ভাতা বেসরকারী চাকুরীজীবিরা পাবে না এমন হতে পারে না! বাংলাার আপামর জনসাধারণের মুখে হাসি ফুটাতে আপনি দয়া করে একবার দেশের বেসরকারীী খাতের কর্তাব্যক্তিদের সাথে বসে সমঝোতার মাধ্যমে সরকারের ঘোষিত উৎসব ভাতার সমপরিমান ভাতা ঘোষণা করলে দেশের মানুষ চিরদিরন আপনার পায়ে হাত রেখে ছালাম করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। রচিত হবে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাস। বাংলার আপামর জনসাধারণের সাথে আমিও আপনার এই মহতি উদ্যোগের আশায় রইলাম।
লেখক: মো. আবদুল কুদ্দুস
শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী