১৯৭১: লাইকা ক্যামেরা, একজোড়া জুতো এবং একজন আব্বাস

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ঘটনাটা ২০০৫ সালের। বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার শোয়েব ফারুকী চট্টগ্রামে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে ‘ফটোব্যাংক গ্যালারী’তে কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ একদিন একটা টেলিফোন পেলেন ঢাকা থেকে। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলছেন, তিনি তার পরিচয় দিলেন। তাঁর নাম আব্বাস।

একটু চমকে গেলেন শোয়েব ফারুকী। ধাতস্থ হতে সময় লাগলো। যদিও প্যারিস থেকে অনেক আগেই যোগাযোগ করেছিলেন আব্বাস, তারপরও বাংলাদেশে তাঁর আগমন এবং একেবারে সম্মুখ সাক্ষাতের সম্ভাবনা তাকে কিছুটা বিহ্বল করে দিল।

ফটোগ্রাফীর যারা অনুরাগী, কিংবা যারা পেশাদার ফটোগ্রাফার, তাঁদের কাছে আব্বাস নামেই তিনি পরিচিত। তাঁকে বলা হয় বিশ্ব ফটোগ্রাফীর ‘গডফাদার’। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের যেখানেই যুদ্ধ, যেখানেই রাজনৈতিক বিপ্লব কিংবা দুর্যোগ, ক্যামেরা হাতে ছুটে গেছেন তিনি।

কয়েকদিন পরে আব্বাস এসে পৌঁছালেন চট্টগ্রামে। কিছু ফলমূল হাতে সোজা শোয়েব ফারুকীর বাসায়।

সেই সাক্ষাতের সময় তিনি সাথে বহন করে এনেছিলেন আরও কয়েকটি জিনিস।

একজোড়া জুতো। পুরোনো সেই জুড়ো জোড়া প্রায় ছিঁড়ে গেছে। ১৯৭১ সালে এই জুতো পরেই নাকি তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলাদেশের রণাঙ্গন।

আর ছিল তার সেই বিখ্যাত লাইকা ক্যামেরা। যে ক্যামেরায় তোলা সাদা কালো ছবি সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিল সেই যুদ্ধের বিভীষিকা।

“আমি ঠিক নিশ্চিত নই, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর সম্ভবত সেটাই তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর”, বলছিলেন শোয়েব ফারুকী, “সেজন্যেই হয়তো যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐ দুটি জিনিস তিনি সাথে বহন করে এনেছিলেন।”

বুধবার প্যারিস থেকে ৭৪ বছর বয়সী ফটোগ্রাফীর এই কিংবদন্তীর মৃত্যুর খবরটি যখন শোয়েব ফারুকী পেলেন, সেটি তাঁকে স্মৃতিভারাক্রান্ত করে তুললো।

ফটোগ্রাফারদের ‘গডফাদার’

আব্বাস তাঁর ক্যামেরায় যেসব ছবি তুলেছেন, তা কেবল ইতিহাসকেই ধারণ করেনি, ইতিহাসও তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা ভিয়েতনাম, ইরানের বিপ্লব কিংবা চিলির সংঘাত, আব্বাসের সাদা-কালো ছবিতে মূর্ত হয়ে আছে সেই ইতিহাস।

তাঁর জন্ম হয়েছিল ইরানে, নাম ছিল আব্বাস আত্তার। কিন্তু পেশাগত জীবনে তিনি কেবল আব্বাস নামেই পরিচিত পান। বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ফটো এজেন্সীগুলোর একটি ‘ম্যাগনামে’র সঙ্গেই কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। কার্যত আব্বাস এবং ম্যাগনাম হয়ে উঠেছিল সমার্থক।

ম্যাগনামের প্রেসিডেন্ট টমাস ডোয়ারযাকের ভাষায়, আব্বাস হয়ে উঠেছিলেন একটি পুরো তরুণ প্রজন্মের ফটোগ্রাফারদের গডফাদার।

ম্যাগনামের পক্ষ থেকে গতকাল তিনি প্রয়াত এই ফটোগ্রাফারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, “একজন ইরানী, যিনি নিজেকে রোপন করেছিলেন প্যারিসে, হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব নাগরিক, কোন বিশ্রাম ছাড়াই তিনি অবিরাম যুদ্ধ, দুযোর্গ, বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের ছবি তুলে গেছেন।”

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর প্রেসিডেন্ট পিয়েরে হাস্কি বলেছেন, “আব্বাস ছিলেন অসাধারণদের মধ্যে অসাধারণ। তার কাজ ছিল বিপুল এবং সেটি ছিল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে।”

বিপ্লব-রণাঙ্গণ-অভ্যুত্থান

প্রথম যে ঘটনা আব্বাসকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল, সেটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তার তোলা অনেক সাদা কালো ছবি এই যুদ্ধের নৃশংসতা এবং ভয়াবহতা যেভাবে তুলে ধরেছিল বাকী বিশ্বের সামনে, সেটা এখন ইতিহাস।

ইরানের ইসলামী বিপ্লব সম্ভবত তাঁর সেরা কাজগুলোর একটি। কিন্তু এই বিপ্লবের পর তাঁকে ইরান ছাড়তে হয় এবং সতের বছরের জন্য তিনি ছিলেন দেশ থেকে নির্বাসিত।

ইরানের বিপ্লব তাকে ইসলাম এবং ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে এবং বাকী জীবন তিনি বিশ্বের নানা প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন এই বিষয়ের ছবি তুলতে। তার এই সংক্রান্ত ফটোগ্রাফীর বই ‘ আল্লাহু আকবর: এ জার্নি ইন মিলিট্যান্ট ইসলাম’কে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ বলে বর্ণনা করা হয়।

২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতেন শোয়েব ফারুকী। সেই সুবাদে বিশ্বের অনেক নামকরা ফটোগ্রাফারের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের সুযোগ হয়। আব্বাসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তখন থেকে।

সেই যোগাযোগের সূত্র ধরে আব্বাস বলেছিলেন, বাংলাদেশে যেতে চান তিনি এবং এক সঙ্গে কিছু কাজ করতে চান।

“ঢাকায় এসে তিনি ফোন দিলেন আমাকে। বললেন আমি চট্টগ্রাম আসছি। তিন দিন থাকবো। তিন দিন আমি আপনার সঙ্গে কাজ করবো।”

‘লাইকা’ হাতে বাংলাদেশে

“যেদিন তিনি চট্টগ্রামে আমার বাসায় প্রথম আসলেন, তখন বিশ্ববিখ্যাত এই ফটোগ্রাফারের বিনয় দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সাক্ষাতের সময় তিনি সাথে নিয়ে এসেছিলেন আমার পরিবারের জন্য কিছু ফলমূল। যেভাবে বাংলাদেশে কেউ কারও বাড়িতে বেড়াতে যান অনেকটা সেভাবে।”

শ্মশ্রুমন্ডিত আব্বাসের সঙ্গে সেই প্রথম সাক্ষাতে তাকে একজন পেশাদার ফটোগ্রাফারের চাইতে বরং কোন সুফি সাধকের মতোই দেখাচ্ছিল। ব্যক্তিগত আচরণেও তাকে মনে হচ্ছিল একেবারেই সাধারণ এক মানুষ।

বাংলাদেশের যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত যে জুতো তিনি বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটি কী উদ্দেশ্যে?

মূলত বাংলাদেশের যুদ্ধের সঙ্গে তার যে স্মৃতি, সেটাকেই হয়তো তিনি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। এটি ছিল বেশ ভারী ধরণের, হেভি ডিউটি জুতো। কোথাও কোথাও ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিন যখন তিনি আমার সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলতে যান, তখন এই জুতোটা একবার পরেছিলেন।”

সেই সফরের সময় তার সাথে নানা ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতির সঙ্গে ছিল তিনটি লাইকা ক্যামেরা। যেগুলো তিনি ব্যবহার করেছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের ছবি তোলার জন্য।

সেই যুদ্ধের নানা ঘটনার টুকরো টুকরো গল্প করেছেন আব্বাস তার এই সফরে। একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন শোয়েব ফারুকী।

“একবার ছবি তোলার সময় নাকি পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার পর সৈন্যরা তাকে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে দাঁড় করিয়ে রাখে। নিজের হাতে ধরা ক্যামেরা সহ দুই হাত উপরে তুললেন আব্বাস। সেই অবস্থাতেই নাকি তিনি লাইকা ক্যামেরার শাটার চেপে ছবি তুলে যাচ্ছিলেন যে সৈন্যরা তাকে হুকুম দিচ্ছিল তাদের।”

“লাইকা ক্যামেরার একটা সুবিধে হচ্ছে এর শাটার চাপলে কোন শব্দ হয় না। আর ক্যামেরাটা ছিল ছোট। ফলে এ কারণেই তিনি এরকম একটা কাজ করতে পেরেছিলেন। ঐ যুদ্ধে এটা নাকি ছিল তার সবচেয়ে মজার এবং স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটি।”

চট্টগ্রামে যে কয়েকদিন তিনি ছিলেন, মূলত একটি মহিলা মাদ্রাসা এবং চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের ছবিই বেশি তুলেছেন। ধর্ম নিয়ে যে কাজ তিনি করছিলেন, সেজন্যেই তিনি মহিলা মাদ্রাসায় গিয়ে সেখানে নানা ধরণের ছবি তোলার কাজটি করছিলেন।

একজন পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে তার কাজের কোন বৈশিষ্ট্যটা সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে?

“আব্বাস ছিলেন সাদা-কালোর অনুরাগী। আলো-আঁধারির খেলা যেন তাকে আকর্ষণ করতো। তার বিখ্যাত বেশিরভাগ ছবিই কিন্তু সাদা-কালো। যেভাবে তিনি আলোকে তার ছবিকে ব্যবহার করেছেন, সেটা একজন শিল্পী যেভাবে রঙকে ব্যবহার করেন, অনেকটা সেভাবে।” বিবিসি বাংলা