বুধবার , ৩ জুলাই ২০২৪ | ২১শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে রেল ট্রানজিট ও তিস্তা বিতর্ক নিয়ে ভারত যা ভাবছে

Paris
জুলাই ৩, ২০২৪ ১২:০৭ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে ভারতকে ‘রেল ট্রানজিট ও করিডর’ দেওয়া এবং ‘তিস্তা পুনরুদ্ধার’ প্রকল্পে ভারতের যুক্ত হওয়ার সমঝোতার ঘোষণা আসার পর দিনদশেক পেরিয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে এই ইস্যুগুলোতে বাংলাদেশে তুমুল বিতর্ক দানা বেঁধেছে, বিরোধী দল বিএনপিও সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানিয়েছে – তবে ভারত কিন্তু এখনও প্রবল আত্মবিশ্বাসী যে এই পদক্ষেপগুলো অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে এবং তা দুই দেশের মানুষের জন্যই উপকার বয়ে আনবে।

‘রেল ট্রানজিট’ প্রশ্নে ভারত সরাসরি জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে ‘বহুমাত্রিক’ সংযোগকে পরের ধাপে উন্নীত করার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ।

পাশাপাশি দিল্লির তরফে এই ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে – বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে ভারতের রেলগাড়ি চললে কী হারে মাশুল, শুল্ক বা ট্রানজিট ফি আদায় করা হবে এবং ওই ট্রেনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এই সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে দুই দেশের ‘টেকনিক্যাল কমিটি’ নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসবে।

তিস্তার জল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশে যে প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার অঙ্গীকার করেছে কিংবা গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে যে আলোচনা শুরু করার কথা জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস তাতে আপত্তি তুললেও সেগুলো থেকেও এতটুকু সরে আসার কোনও পরিকল্পনা ভারতের নেই বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আগরতলার কাছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রেললাইন বসানোর কাজ চলছে। ২০২১ সালের ছবিছবির উৎস,এঊঞঞণ ওগঅএঊঝ
ছবির ক্যাপশান,আগরতলার কাছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রেললাইন বসানোর কাজ চলছে। ২০২১ সালের ছবি
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এর মধ্যে কেন্দ্রকে চিঠি লিখে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাজ্যবাসীর ‘স্বার্থের সঙ্গে আপস করে’ বাংলাদেশের সঙ্গে জল নিয়ে কোনও চুক্তি তিনি মেনে নেবেন না। কিন্তু তার এই হুমকিকেও আমল দেওয়া হচ্ছে না, অন্তত এখনকার মতো তো বটেই!

তবে দিল্লিতে একাধিক পর্যবেক্ষক ও বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের গবেষকরা বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশে রেল ট্রানজিট বা তিস্তা প্রকল্পের মতো পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করতে হলে ভারতকেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বড়সড় ‘ছাড়’ দিতে হবে বলে তাদের ধারণা।

সেগুলো কী হতে পারে, তা এখনই স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশকেও ভারতের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়ক ট্রানজিট, তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের একটা বড় অংশ ঋণের বদলে অনুদানে (‘গ্রান্ট’) পরিবর্তন করা – এই সব সম্ভাব্য ছাড়ের কথা তারা উল্লেখ করছেন।

তবে ভারত সরকারের তরফে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বার্তা দেয়া হয়নি।

বাংলাদেশের ভেতরে বিরোধী দলীয় দলগুলোসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে যে এই সব উদ্যোগের বিরোধিতা করা হচ্ছে, সেটাকে দিল্লির সরকারি কর্মকর্তারা বা ভারতের কূটনৈতিক মহল বিশেষ একটা আমল দিচ্ছেন না।

তারা বলছেন, গত দশ-পনেরো বছরে বাংলাদেশে ভারতের বহু উদ্যোগই সে দেশে একটা অংশের মানুষের বাধার মুখে পড়েছে – কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু’দেশের সরকারের সদিচ্ছায় সেই সব প্রকল্পই সফলভাবে রূপায়িত হয়েছে, দু’দেশের মানুষই তা থেকে লাভবান হচ্ছেন।

বাংলাদেশের নীলফামারিতে তিস্তা ব্যারাজছবির উৎস,এঊঞঞণ ওগঅএঊঝ
ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশের নীলফামারিতে তিস্তা ব্যারাজ
ফলে রেল ট্রানজিট ও তিস্তা পুনরুদ্ধার প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হবে না বলেই দিল্লির বিশ্বাস।

সাউথ ব্লকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য:
গত ২২শে জুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী মোদীর মধ্যেকার বৈঠকের পরই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা যে ব্রিফিং করেছিলেন, তাতেই তিনি এই দুটো প্রকল্পের রূপরেখার বর্ণনা দেন।

‘রেল ট্রানজিট’ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল, “এটা হলো ভারতেরই একটা অংশ থেকে আর একটা অংশে যাওয়া, যেখানে ট্রেন যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে।”

এটা বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় দেশেরই মানুষ ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে বলে তিনি দাবি করেন।

জুলাইতেই গেদে-দর্শনা সীমান্ত থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত পর্যন্ত রুটে এই রেলপথে মালবাহী ট্রেন পরীক্ষামূলক চলাচল করবে বলেও তিনি ঘোষণা করেন।

আর তিস্তা প্রকল্প প্রসঙ্গে মি কোয়াত্রা জানান, ওই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হল তিস্তার জলের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ (ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কনজার্ভেশন), কিন্তু তিস্তার জল ভাগাভাগি নিয়ে প্রস্তাবিত চুক্তির সঙ্গে ওই পদক্ষেপের কোনও সম্পর্ক নেই।

এর দিনকয়েক পরে (২৮শে জুন) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও মুখপাত্রকে এই দুটো ইস্যুতে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।

রেল ট্রানজিট প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়, এই পথে চলাচলের অনুমতি দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশকে কী হারে শুল্ক দিতে হবে সেটা কিছু স্থির হয়েছে কি না? আর বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ভারতের ট্রেনে নিরাপত্তার ব্যবস্থাই বা কীভাবে হবে?

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রাছবির উৎস,এঊঞঞণ ওগঅএঊঝ
ছবির ক্যাপশান,ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা
জবাবে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এই প্রকল্পের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে বলেন, “আমাদের দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটিকে আমরা ফিজিক্যাল, ডিজিটাল ও আরও নানা পদ্ধতিতে ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলছি – এই রেল সংযোগ হল তারই একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও মানুষে-মানুষে সম্পর্ককে উন্নীত করবে।”

ট্রানজিট ফি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে তিনি বলেন, “এগুলো হলো প্রকল্পটার টেকনিক্যাল দিক। যখন আমাদের দুই দেশের সরকার এই প্রকল্পের জন্য টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করবে, তখন সেই কমিটির বৈঠকে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।”

তার কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, ট্রানজিট ফি বা মাশুলের হার, কিংবা ট্রেনে কোন দেশের নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হবে – এসব বিষয় নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।

তিস্তা প্রকল্প নিয়ে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় টেকনিক্যাল (কারিগরি) টিম পাঠানোর ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আপত্তি তুলেছেন, এই বিষয়ে ভারত সরকারের অবস্থান কী?

তিস্তা নিয়ে সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে মুখপাত্র এখানে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির প্রসঙ্গটিতে চলে আসেন।

রণধীর জয়সওয়াল দাবি করেন, গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় প্রবেশ করার আগে ভারত আগে নিজেদের দেশের ভেতরে একটি ‘ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ) কমিটি’ গঠন করেছে এবং সেখানে অন্য সব স্টেকহোল্ডারের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও প্রতিনিধিও ছিলেন।

শুধু তাই নয়, তিনি আরও জানান, পশ্চিমবঙ্গ কমিটির বৈঠকগুলোতে নিয়মিত যোগ দিয়েছে, এপ্রিল মাসেও রাজ্য সরকার তাদের লিখিত মতামত দিয়েছে এবং তার পরই কমিটি তাদের রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে।
অর্থাৎ, মুখপাত্রের বক্তব্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ না-করে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে এগোনো হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জীর এই অভিযোগ ঠিক নয়।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল ট্রানজিট বা তিস্তা প্রকল্পে সক্রিয় অংশগ্রহণ – কোনওটা থেকেই যে ভারত পেছোনোর কথা ভাবছে না, রণধীর জয়সওয়ালের কথায় তা ছিল স্পষ্ট।

‘বাংলাদেশেরও লাভ, এটা তারা ঠিকই বুঝবেন’
ভারতের সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদদের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। ঢাকাতে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন দীর্ঘদিন, পরে অবসর নেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে যে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল, অবসরের পর মি শ্রিংলাকে তার প্রধান কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দিয়েছিল মোদী সরকার। বাংলাদেশ জোটের সদস্য না হলেও সেই সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত ছিলেন শেখ হাসিনাও।

ভারতের বর্তমান সরকারের বাংলাদেশ নীতি বা ‘আউটরিচ’টা যারা তৈরি করেছেন, হর্ষবর্ধন শ্রিংলা তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

সেই মি শ্রিংলা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, এই রেল ট্রানজিট বা তিস্তা প্রকল্প যে আখেরে বাংলাদেশের জন্য লাভদায়ক হবে সেটা ও দেশের বেশিরভাগ মানুষ বুঝবেন – সে ব্যাপারে তার কোনও সন্দেহই নেই। সূত্র: বিবিসি বাংলা

সর্বশেষ - জাতীয়