প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সমকালিন চিন্তাভাবনা

শিক্ষা প্রতিটি মানুষের জন্মগত একটি মৌলিক অধিকার। যা আমাদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। একথা সবাই জানে ও মানে। প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিক্ষার ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষার উপরই ভিত্তি করে একজন শিক্ষার্থীর পরবর্তী স্তরে শিক্ষা গ্রহন করে। দীর্ঘদিন প্রাথমিক শিক্ষা অবহেলিত থাকার পর ০১-০৭-১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৭,৬১০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় করণ করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষার অন্যান্য স্তর যেমন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে।

০১-০৭-১৯৭৩ সালের পর অনেক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিšু— প্রাথমিক শিক্ষার দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চেতনা ও স্বপ্নকে লালন করে তাঁর কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন অবহেলিত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। তিনি ০১/০১/২০১৩ সালে একই সাথে ২৬,১৯০ টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন।

বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করেছে। প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষক কর্মকর্তা সকলের জন্য আধুনিক ও উন্নতমানের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করেছে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিখন শেখানো কার্যাবলী পরিচালনার জন্য সঠিকভাবে সহযোগিতা করছে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানো কার্যাবলী আরও আনন্দপূর্ণ ও সাবলীল হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আরও উন্নত এবং অপেক্ষাকৃত স্থায়ী হচ্ছে। তাই তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলা যায়‘‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।’’

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য সরকার যথাযথ পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করেছে। বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী অনেক উন্নত মানের। বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু করেছে। যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা। ২০১৭ সালে ৮০% সৃজনশীল প্রশ্নের দ্বারা শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২৫% শিক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে যেহেতু অন্যান্য শিক্ষা নির্ভর করে তাই প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের উন্নত মানের প্রশিক্ষনের জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষনে না পাঠিয়ে মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তারায় বেশি বিদেশে প্রশিক্ষনে যায়। উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ধ্যান ধারনা অবলোকন করে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। যেমন: নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ। এইসব রাষ্ট্রের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচী শিখন শেখানো পদ্ধতি শিক্ষকদের প্রশিক্ষন, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও শিক্ষকদের প্রমোশন বিষয়ের জ্ঞান আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রয়োগ করতে হবে।

আমার মনে হয় প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সবার আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বর্তমান সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক মূল্যায়ন করেছে। তারপরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবী প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১০ম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১ তম গ্রেডে প্রদান করার জন্য। আমাদের দেশের জ্ঞানী, গুণি, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা শিক্ষকদের মর্যাদা প্রদান করেন সবার উপরে। কিন্তু শিক্ষকদের যথাযথ বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে বারবার পিছুপা হতে দেখা যায়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো হয়নি। আমার মনে হয় শিক্ষকদের মর্যাদা সবার উপর এই
কথাগুলো শুধুই অলীক। তাই সরকারের কাছে আমার দাবী শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা শীঘ্রই প্রয়োজন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রমোশনের বিষয়টি অত্যন্ত ধীর গতি। প্রমোশনের ক্ষেত্রে সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। ২০০৯ সাল থেকে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকের প্রমোশন বন্ধ আছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকের প্রমোশন বন্ধ থাকার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ২১,০০০ পদ শূন্য আছে। তবে আশার কথা হলো যে, এ বছর জুন মাসে সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন হওয়ার কথা। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম ঢাকা জেলায় ৮৮ জন সিনিয়র সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের চলমান দায়িত্ব পেয়েছে। কিšু— আজ পর্যন্ত দেশের কোন উপজেলায় সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকের প্রমোশন শুনতে পারলাম না। শোনা যাচ্ছে যে নব সরকারী সিনিয়র সহকারী শিক্ষক গণ কেস করার ফলে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকের প্রমোশন বন্ধ হয়ে আছে।

যদি তাই হয় আমার মতামত হলো বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (ইচঝঈ) এর মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে উত্তীর্ণের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে প্রমোশন দেওয়া যেতে পারে।
সরকার ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে ৮৯৮ জন নন ক্যাডার হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দিচ্ছে। এবং প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু নব সরকারী সিনিয়র সহকারী শিক্ষকগণ স্থানীয় ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত। তাঁদের কোন ধরনের সরকারী ভাবে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে চাকুরী নিতে হয়নি। কাজেই বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন(ইচঝঈ) মাধ্যমে পুরাতন সরকারী সিনিয়র সহকারী শিক্ষকগণ ও নব সরকারী সিনিয়র সহকারী শিক্ষকগণ পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন দিলে সমস্যা সমাধান হতে পারে। আর এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবি সিনিয়র সহকারী শিক্ষকগণ প্রধান শিক্ষক হওয়ার পদ সুগম হবে। এতে প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশনের ক্ষেত্রে কোন ধরণের সমস্যার সৃষ্টিও হবে না। কারণ প্রমোশনের পরীক্ষায় সবাই অংশগ্রহণের সমান সুযোগ পাবে। আর যারা দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবি তারাই প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পাবে। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে গতি আরও বৃদ্ধি পাবে। যোগ্য ও মেধাবি সিনিয়র সহকারী শিক্ষকগণের প্রধান শিক্ষক হওয়ার পথও সুগম হবে।

একটি দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবার আগে শিক্ষা প্রয়োজন। আর সব শিক্ষার সূতিকাগার হলো প্রাথমিক শিক্ষা। তাই সরকারকে সবার আগে প্রাথমিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত ও শোষণহীন সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সবার আগে প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর শিক্ষানুরাগী মনোভাব নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য পাওয়া সম্ভব।

লেখক-
মোঃ ওসমান গনি
সহকারী শিক্ষক
মচমইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়
বাগমারা, রাজশাহী।