প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে মানুষ কতোটা সচেতন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ঢাকার উত্তর কাফরুলের বাড়িটিতে প্রবেশ করতেই আমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে ৫/৬টি কুকুর । তবে অভয় দেন বাড়ির মালিক মিথিলা শারমিন চৈতি। রাস্তা থেকে এনে আশ্রয় দেয়া এই কুকুরগুলোকে তিনিই দেখাশোনা করেন।

তেমনি বাড়ির বাইরে এমন আরও ৫০টিরও বেশি কুকুর রয়েছে যাদের তিনি নিয়মিত খাবার খাওয়ান, গোসল করান এমনকি চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। আবার বাড়ির ভেতরে তিনি পালছেন একটি দুটি নয়, মোট আটটি বেড়াল। ছোটবেলা থেকে এই প্রাণীদের জন্য কিছু করার কথা ভাবতেন তিনি।

“রাস্তায় যাওয়া আসার সময় যখন দেখতাম ওরা ইনজুরড হয়ে পড়ে আছে, খুব খারাপ লাগতো। ইচ্ছা হতো যদি আমি কিছু করতে পারতাম। সেই ইচ্ছা থেকেই আমার চেষ্টার শুরু।”

“কখনও ভেটের (পশু চিকিৎসক) কাছে নিয়ে যেতাম। আমি এখন এদের রেগুলার খাওয়াই। মাসে একবার গোসল করাই, ট্রিটমেন্ট করাই।”-বলেন শারমিন চৈতি

এই কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ দুটি স্কুলের চাকরির থেকে ইস্তফাও দিয়েছেন তিনি।

“আগে আমি একটা স্কুলে টিচিং করতাম। কিন্তু আমার এই কাজ করে পেরে উঠছিলাম না। তাই চাকরি ছেড়ে এখন কয়েকটা টিউশনি করছি। সেখান থেকে যা টাকা পাই সেটা দিয়েই এদের খাবার চিকিৎসা চলছে।”

তবে মিস শারমিনের এই পথচলা এতোটাও সহজ ছিল না। একবার স্থানীয় এক প্রভাবশালীর তোপের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাকে।

“সেই লোক এই এলাকার প্রভাবশালী। আসলে ওই লোকটার ইনটেনশন ছিল আমাকে রাস্তায় হ্যারাস করা। তার কথা হল, আমার জন্য কুকুর তাকে জ্বালাচ্ছে। তার প্রশ্ন আমি যে কুকুরদের খাওয়াই, এই টাকা আমি কোথা থেকে পাই।”

“কেউ কেউ বলে কোরিয়ায় কুকুর সাপ্লাই দেই, কেউ বলে এনজিও থেকে আসে, কেউ বল সরকার টাকা দেয়। একদিন তো রাস্তায় লোক জড়ো করে ফেলেছিল। আসলে মানবতা থেকেও যে মানুষ কিছু করতে পারে, এটা এখনও কেউ ভাবতে পারেনা।”- অনেকটা আক্ষেপের স্বরেই বলেন মিস শারমিন।

প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সংগঠন

বাংলাদেশের রাস্তায় বিচরণ করা পশুদের ওপর মানুষের নিষ্ঠুরতার বেশ কয়েকটি খবর সম্প্রতি সংবাদের শিরোনামে হয়ে উঠেছে। নাহলে ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একদল তরুণ সংগঠন এই বিষয়গুলোকে সামনে আনে। রাস্তার এসব প্রাণীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে এখন এগিয়ে এসেছে এমন বেশ কয়েকটি সংগঠন। যার মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান এরিমধ্যে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হয়েছে, সেগুলো হল অভয়ারণ্য, কেয়ার ফর পজ, এনিমেল লাভার্স অব বাংলাদেশ এবং পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।

এছাড়া ফেসবুকভিত্তিক আরও কয়েকটি সংগঠন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এই সংগঠনগুলো মূলত এসব প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। যেমনটি বলছিলেন কেয়ার ফর পজের চেয়ারম্যান সৌরভ শামীম।

“কোন প্রাণীকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেলে আমরা প্রথমে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি, কোথাও প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতার খবর পেলে সেখানে ছুটে যাই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কিংবা যেসব প্রাণীর জরুরি আশ্রয়ের প্রয়োজন, রাস্তায় ছাড়া যাচ্ছেনা। তাদেরকে শেল্টারে নিয়ে যাই না’হলে অ্যাডপশনের ব্যবস্থা করি।”

এই এই কাজগুলোর বেশিরভাগ পরিচালিত হয় কর্মীদের নিজেদের অর্থায়নে। সরকারি নিবন্ধিত সংস্থা হিসেবে সরকারি বরাদ্দ পাওয়ার কথা থাকলেও, এমনটা না হওয়ায় অনেকটা হতাশা প্রকাশ করেন মিস্টার শামীম।

“আমার কেরানীগঞ্জের শেল্টারে এখন ৬০টা কুকুর আর ৫০টা বেড়াল আছে, এগুলোর পেছনে মাসে খরচই হয় দুই লাখ টাকা। আমার ব্যক্তিগত যে রেস্টুরেন্টটা আছে সেটার লাভের পুরো টাকাটা এসবের পেছনে চলে যায়।”

“কিছু ডোনেশন আসে, হাসপাতাল থেকে কিছু আসে। এভাবে সংস্থাটা কতদিন চালাতে পারবো জানিনা। সরকার যদি আমাদের কিছু অনুদান দিতো, শেল্টারের একটা জায়গা দিতো, যেখানে প্রাণীগুলো থাকবে। তাহলে তো আমাদের ভাড়াটা অন্তত বেঁচে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানিও সাহায্য করতে পারে।”

নিজের পুরো বাড়িটাই ছেড়ে দিয়েছেন কুকুর বেড়ালদের জন্য

এনিমেল লাভার্স অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান দীপান্বিতা হৃদি নারায়ণগঞ্জে নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাড়িটিতেই কুকুর বেড়ালের থাকার ব্যবস্থা করেছেন।

এছাড়া ঢাকার টিএসসি এলাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকার কুকুর বেড়ালদের স্বেচ্ছায় দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালিয়ে আসছেন গত কয়েকবছর ধরে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো তাহলে আমি পৃথিবীর সব স্ট্রে ডগ আর ক্যাটদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতাম, কিন্তু আমারও লিমিটেশনস আছে। তাই নিজের দ্বারা যেটুকু সম্ভব সেটুকুই করি।”

“এই যে রাস্তায় অনেক কুকুর বেড়াল পড়ে থাকে যাদের শেল্টার দরকার কিন্তু যাওয়ার জায়গা নাই। তাদের কথা ভেবেই আমার এই শেল্টারটা বানানো।” এতো কাজ করতে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিতে হয়েছে মিস হৃদিকে। এক্ষেত্রে তিনি সবসময় তার পরিবারকে কাছে পেয়েছেন।

এসব প্রাণীর লালন পালনের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ খরচ বহন করছে তার পরিবারই। তবে বাংলাদেশের মানুষ যদি বিদেশি কুকুর বিড়ালের পরিবর্তে আমাদের দেশি প্রাণীগুলোকে অ্যাডপ্ট করে তাহলে, এই সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে বলে মিস হৃদি আশা করেন।

প্রাণী নিষ্ঠুরতা চলছেই

প্রাণীর প্রতি মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এসব বিষয়েও এক ধরণের বড় ভূমিকা রাখছে এই বেসরকারি সংগঠনগুলো। আর সেই কাজে তাদের মূল শক্তি হিসেবে অর্থাৎ প্রতিবাদ থেকে শুরু করে তাদের সচেতনতামূলক প্রচারণা-প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

ফেসবুকে তাদের পোস্টগুলো ঘেঁটে দেখা যায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাণী নিষ্ঠুরতার ঘটনা উঠে আসছে। এমনই এক নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল সিথি রহমানের কুকুর। তিনি জানান তার সেই বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা।

“আমার কুকুর কিন্তু তার কোন ক্ষতি করেনি। কারণ আমরা তাকে ট্রেনিং দিয়ে রেখেছি যেন সে কাউকে ডিস্টার্ব না করে। খুব ফ্রেন্ডলি ছিল। কিন্তু মানুষের ওকে নিয়ে এতো সমস্যা যে এলাকাই ছাড়তে হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। একদিন আমাদের দারোয়ান ডেকে বলল যে আমাদের কুকুরের চিৎকার আওয়াজ পেয়েছে। আমরা গিয়ে দেখি কেউ কার মাথাটা ফাটিয়ে দিয়েছে। তারপর অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি”

তবে প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতার প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ বলে জানান কেয়ার ফর পজের জেনারেল সেক্রেটারি জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব নির্যাতনকারীদের পরিচয় খুঁজে বের করা যায়না।

“আমাদের কাছে প্রতিদিন তিনটা থেকে ছয়টা অভিযোগ আসে। সেটাও আবার আমাদের গ্রুপের মেম্বারদের থেকে। সারা দেশব্যাপী এই এনিমেল ক্রয়েলটি হয় আরও অন্তত ১০গুণ বেশি।

“এই বিষয়ে কেউ মুখ খোলেনা, তেমন কোন এভিডেন্সও থাকেনা। তাও আমরা চেষ্টা করি আশেপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে, সিসিটিভি ক্যামেরা দেখতে।” বলছিলেন জাহিদ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত রাস্তার কুকুর নিধন করা আইনগতভাবে বৈধ ছিল। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সিটি কর্পোরেশন ঘাড় মটকে হত্যা করতো

প্রতি কুকুর হত্যা বাবদ অর্থও পেতেন এসব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভেটরা।

পরে অভয়ারণ্যের প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয় রাস্তার কুকুর নিধন। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি, নিউটারিংসহ অন্যান্য উপায় অবলম্বনের কথা জানান তারা।

প্রাণীদের প্রতি মানুষের এই বিদ্বেষের কারণ কি

সম্প্রতি রাস্তার এই কুকুর বেড়ালগুলোর প্রতি মানুষের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের অভিযোগ উঠেছে, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার।

তবে তারা সেই বক্তব্য মাইক্রোফোনে রেকর্ড করার অনুমতি দেননি। তাদের কেউ কেউ ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জান্নাতি শহীদ আশা মনে করেন এই প্রাণীগুলো হিংস্র এবং রোগজীবাণু ছড়ায়।

“আমার এই কুকুরগুলোকে দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে। এগুলো তো রাস্তায় থাকে। এগুলো যে আমাকে দেখে কামড়াতে আসবে না তার কোন গ্যারেন্টি নাই। মানে এতো নোংরা একটা প্রাণী। আমার একদমই পছন্দ না।”

যদিও মিস্টার শামীম যিনি কিনা কেয়ার ফর পজের চেয়ারম্যান তিনি এই মনোভাবকে অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন।

নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানিয়েছেন যে মানুষ সাধারণত ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এ ধরণের কাজ করে থাকে। যার ভুক্তভোগী হয় অসহায় প্রাণীগুলো।

এই ধরণের নিষ্ঠুরতা বন্ধে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মিস্টার শামীম বলেন, “এই যে বাচ্চারা কুকুর বেড়াল দেখে ঢিল ছোড়ে, এটা যদি বাবা মায়েরা মানা করে, বোঝায় যে কোন প্রাণীকে কষ্ট দেয়াটা ঠিক না, সেটাও কিন্তু কাজে আসে।”

“স্কুলগুলো প্রাণীর প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষা দিতে পারে। তাছাড়া কোন ধর্মে প্রাণীদের কষ্ট দেয়ার কথা বলা হয়নি। ধর্মের প্রপার শিক্ষাটাও পৌঁছে দিতে হবে। আপনি এদের পছন্দ নাই করতে পারেন। তাই বলে আঘাত করবেন না।”

বাংলাদেশের আইন কি বলে?

সামাজিক সচেতনতার অভাব সেইসঙ্গে প্রাণী নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে দেশে যে একটি আইন আছে সেটা নিয়ে অজ্ঞতার কারণেই এ ধরণের ঘটনা ঘটছে বলে জানান আইনজীবী জান্নাতুল আরা তিথি।

প্রাণীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রচলিত আইনটি যথেষ্ট নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশে প্রাণী নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বর্তমানে যে আইনটি কার্যকর আছে, সেটি হল ১৯২০ সালের একটি আইন।

সেখানে কোন প্রাণীকে হত্যা করা হলে শাস্তি হিসেবে তিন থেকে ছয় মাসের জেল ও সবোর্চ্চ ২শ টাকা দণ্ড ধার্য করা হয়েছে।

“ওই ব্রিটিশ আমলের ২শটাকা অনেক টাকা। এখন এটা কিছুই না। তিন মাস, ছয় মাসের কারাদণ্ডেও তেমন কিছু হয়না।” বলেন জান্নাতুল আরা।

তার মতে শুধু আইন দিয়েই কিন্তু সমাধান হবেনা। এই যে একটা আইন আছে এটা মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। যে প্রাণীদের নির্যাতন করলে পার পাওয়া যাবেনা।