দুর্নীতি দমন কমিশন

প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোন কর্মকর্তা হেনস্থার শিকার হলে তার প্রভাব কী হতে পারে

সিল্কিসিটি নিউজ ডেস্ক:

দুদকের কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের একজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এই কর্মকর্তা প্রভাবশালীদের কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেজন্য তাকে চাকরি হারাতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এর আগেও বিভিন্ন সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের চাকরি হারানো বা হেনস্থা হওয়ার নজির রয়েছে।দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা বলছেন, দুদকের কর্মকর্তাকে বরখাস্তের ঘটনার পর দুর্নীতি দমনে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেবে।

তারা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো সমাজে নেতিবাচক বার্তা দেয়। চাকরিচ্যুত হওয়া দুদকের উপ সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন নিজেই অভিযোগ করেছেন যে, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলার তদন্ত করে তিনি আমলা, রাজনীতিকসহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিলেন, সেজন্য রোষানলে পড়ে তাকে চাকরি হারাতে হলো।

যদিও এসব অভিযোগের সাথে তাকে চাকরি থেকে অপসারণের সম্পর্ক নেই বলে দুদক বলছে। কিন্তু দুদকের পদক্ষেপ নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

দুদকের সাবেক একজন কমিশনার ড: নাসিরউদ্দিন আহমদ বলেছেন, প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে।কিন্তু এমন অবস্থান নেয়ার কারণে কোন কর্মকর্তার চাকরিচ্যুত হওয়ার অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে দুদকের প্রতি আস্থার অভাব আরও বাড়বে বলে মনে করেন ড: আহমদ।

“আমাদের সমাজে এত বেশি স্বার্থের সংঘাত, সেখানে যারা ক্ষমতাবান মানুষ, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গেলে তখনই আপনি অনেক প্রতিরোধের মধ্যে পড়বেন,” বলেন ড: আহমদ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে এবং পরে দুদকের কমিশনার পদে পাঁচ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে ড: নাসিরউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমি দেখেছি, পয়সাওয়ালা লোকজন বা প্রভাবশালীরা যদি কোন অবৈধ বা অন্যায় কাজ করে-তাহলে এদের ধরা খুবই কঠিন।”

“দুদকের কর্মকর্তার অপসারণের এই ঘটনাটা আমি জানি না। তবে অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে তা সুশাসনের পরিপন্থী,” বলেন ড: আহমদ।

হেনস্থা হওয়ার নজির এখন দুদকের একজন কর্মকর্তা চাকরি হারালেন। এর আগেও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে চাকরির ক্ষেত্রে হেনস্থা হওয়ার নজির রয়েছে।

এমন একজন কর্মকর্তা মাহবুব কবির মিলন চাকরির শেষ জীবনে দেড় বছর ওএসডি থাকার পর অবসরে গেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি সরকারের নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রপাপ্ত চেয়ারম্যান থাকার সময় প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তাকে রেল মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে বদলি করা হয়েছিল। অল্প সময় পরে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে ওএসডডি করে রাখা হয়েছিল। চাকরিচ্যুত কর্মকর্তার অভিযোগ সত্য হলে দুদকের প্রতি আস্থার অভাব বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক একজন কর্মকর্তা।

দুদকেরই সাবেক একজন মহাপরিচালক মুনির চৌধুরীও একই কারণে চাকরিতে বদলি বা হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করেন ড: তোফায়েল আহমেদ। তিনি মনে করেন, সুশাসনের অভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত প্রভাবশালী চক্র শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এমন পরিস্থিতি হচ্ছে। সেজন্য কেউ শক্ত অবস্থান নিলেই তাকে হেনস্থা হতে হয়।

“আইন অনুযায়ী কাজতো আমরা দেখছি না। যে কয়েকজন কর্মকর্তা যারা ভাল কাজ করতে চায়, তারা হেনস্থার শিকার হলে অন্য কেউ উৎসাহ পাবে না,” বলেন ড: তোফায়েল আহমেদ। তিনি উল্লেখ করেন, “প্রভাবশালীদের অন্যায় বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ ঘুরে দাঁড়ালে আগে বিচার হতো। এখন উল্টোটা হচ্ছে। সেখানেই মুল সমস্যা।”

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে পুরস্কার হিসাবে যদি হেনস্থার শিকার হতে হয়, তাহলে সেটা সমাজে নেতিবাচক বার্তা দেবে। দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকারী সুলতানা কামাল মনে করেন, দুদকের কর্মকর্তার চাকরি হারানোর মতো ঘটনাগুলো দুর্নীতিবাজদেরই উৎসাহিত করবে।

“যারা আইন বা নীতি প্রয়োগ করবেন বা বাস্তবায়ন করবেন, তাদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব এবং অবক্ষয় ঘটেছে। “ফলে কেউ যদি কোন অন্যায়কে জনসমক্ষে আনার চেষ্টা করেছে, তখন তাকেই দোষারোপ করে সম্মিলতভাবে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে,” বলেন সুলতানা কামাল।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের সরকারের জিরো টলারেন্স রয়েছে।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত পরিস্কারভাবে বলেছেন যে দুর্নীতির ব্যাপারে এখানে জিরো টলারেন্স। দুর্নীতির প্রশ্নে কখনও আমরা কোন চাপের কাছে মাথা নত করতে রাজি নই,” বলেন মি: হক।

তিনি আরও বলেন, “কোন সংস্থার ব্যাপারে এরকম অভিযোগ যদি আসে, তাহলে আমরা তা তদন্ত করে দেখার পরামর্শ দেব।”

কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, এসব ঘটনার তদন্ত কখনও হয় না। সর্বশেষ দুদকের কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনার যে তদন্ত করা হবে- এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ রয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা