প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বিমান দুর্ঘটনার মুহূর্ত

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:  ‘খুবই নিচ দিয়েই উড়ছিল উড়োজাহাজটি। দেখে ভাবলাম, এটি পর্বতের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই বিস্ফোরণের শব্দ। এক-দুই সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার বিস্ফোরণ। এরপর নগরীর আকাশ ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। বিমানবন্দরের দিকে সেনাসদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা ও অগ্নিনির্বাপকদের দৌড়াদৌড়ি। আহতদের বাঁচানোর আবেদন। লাশবাহী গাড়িতে নিথর মরদেহ তোলা এবং হা-হুতাশ।’ নেপালে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন আমান্ডা সুমারস।

আমান্ডা সুমারস মূলত মার্কিন নাগরিক। চাকরিসূত্রে থাকেন নেপালে। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশেই তার অফিস ও বাসা। উড়োজাহাজটি যখন বিধ্বস্ত হয়, তখন সুমারস বাসার ছাদে ছিলেন। বিধ্বস্ত হওয়া ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি দেখেছেন তিনি।ঘটনার প্রায় একই বর্ণনা পাওয়া যায় কেয়াল নামের এক নেপালি মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। অভ্যন্তরীণ এক ফ্লাইটে নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন তিনি। এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘উড়োজাহাজটি খুবই নিচ দিয়ে উড়ছিল। এটা যারা দেখেছে, সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। আপনিও দেখলে বলতে বাধ্য হতেন যে, এটা স্বাভাবিক অবতরণ নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা রানওয়ের ঠিক কাছেই অবতরণ করে এবং অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায় এবং আগুনের সূত্রপাত হয়। নিজের চোখে দেখেও কয়েক মিনিট অনেকে বুঝতে পারছিলেন না যে, কী হচ্ছে! এটা ছিল খুবই ভয়াবহ এক ব্যাপার।’

দুর্ঘটনার সময় ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করছিলেন নেপালের সেনাসদস্য বালকৃষ্ণ উপাধ্যায়। বিমানটির বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তটিকে তিনিও ‘ভয়াবহ’ বলে মন্তব্য করেন। তার ভাষায়, ‘হঠাৎ করেই উড়োজাহাজটি একটি শূন্য মাঠের খুব নিচ দিয়ে ছুটতে শুরু করে। এরপর রানওয়ের পাশে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। একইসঙ্গে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হতে থাকে। এ সময় চূর্ণবিচূর্ণ বিমানটির কাছে দৌড়ে যান উদ্ধারকারীরা। তখন বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটির ভেতর থেকে নেপালি যাত্রীরা ‘আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে’ বলে চিৎকার করছিলেন। আর বাংলাদেশি যাত্রীরা ইংরেজিতে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমাকে সাহায্য কর, দয়া করে আমাকে সাহায্য কর’।

পর পর দুই বার বিস্ফোরণের পর পরই উড়োজাহাজটি আচড়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন ঘটনার আরও এক নেপালি প্রত্যক্ষদর্শী কৈলাশ অধিকারী।

কৈলাশ অধিকারী ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি জ্বালানি কোম্পানিতে কাজ করেন। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় তিনি ঘটনাস্থলের পাশেই ছিলেন। তার ভাষায়, ‘পর পর দুই বার বিকট শব্দ হয়। শব্দের উৎসের খোঁজে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারি, উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হওয়ার প্রায় ১৫ মিনিট পর অগ্নিনির্বাপকরা ঘটনাস্থলে আসেন। তারা আরও আগে আসতে পারলে আরও বেশি মানুষকে বাঁচানো যেতো।’

ইউএস বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার কিছু সময় পর ঘটনাস্থলে ছুটে যান নেপালি সাংবাদিক ভদ্র শর্মা। তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজটি যখন বিধ্বস্ত হয়, তখন ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ছিলাম। অভিবাসন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজেই আমি সেখানে ছিলাম। উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে বিমানবন্দরে ছুটে যাই। বিমানবন্দরের গেটে পৌঁছে নুড়ি পাথরের একটা স্তুপে দাঁড়িয়ে দেখি, বিধ্বস্ত বিমানের ইঞ্জিন থেকে আগুন বেরুচ্ছে। আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানে পানি ছিটানো হচ্ছে।’

ভদ্রা শর্মা আরও বলেন, ‘একজন অগ্নিনির্বাপক আমাদের (সঙ্গে থাকা কয়েকজন নেপালি ফটো সাংবাদিক) তার পিকআপের পেছনে উঠতে বলেন। এরপর আমরা ঠিক ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছি। ওই সময় আমার নাকে প্লাস্টিক পোড়ার গন্ধ এসে লাগছিল, খুবই বিষাক্ত গন্ধ।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলের চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ঘাস থেঁতলে গিয়ে কালো হয়ে গেছে। এখানে সেখানে ছেঁড়া কাগজ, সিটের ছিন্নভিন্ন টুকরো, পানির বোতল ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। বিধ্বস্ত বিমানটির দিকে তাকিয়ে দেখি, এটি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এর বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গেছে। তবে এটির লেজ তখনও অক্ষত ছিল, আর লেজ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।’

ভদ্রা শর্মা বলেন, ‘পুড়ে যাওয়া ঘাসে সারিবদ্ধভাবে কিছু হলুদ রঙের ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখলাম। হতাহতদের উদ্ধারে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।’

ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সোমবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে পৌঁছায় বিমানটি। অবতরণের সময় এতে আগুন ধরে যায়। এরপর বিমানবন্দরের কাছেই একটি ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয় এটি। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের মুখপাত্র প্রেমনাথ ঠাকুর জানান, ২৫ জনকে কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাতজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। নেপালের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র গোকুল ভান্ডারি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ৫০টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়েছে।’ ওই সেনা মুখপাত্র জানান, নয়জনের এখনও কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও অটোয়া সান।