রাজশাহীতে প্রতারক চক্রের হোতাদের বাড়িতে পিতল কেটে তৈরী হচ্ছে স্বর্ণের বার

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী নগরীতে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে ঘটছে রিকশা যাত্রীদের নিকট স্বর্ণের বার বিক্রির নামে প্রতারণার ঘটনা। সেই নকল সোনা কিনে বাইরে থেকে রাজশাহী নগরীতে আসা লোকজন হচ্ছেন প্রতারিত। বিশেষ করে গ্রামের সহজ-সরল অনেক মানুষকে চিকৎসা করাতে এসে রিকশা চালক এবং অটোরিকশা চালক নামধারী এসব প্রতারকদের কাছে টাকা-পয়শা খুইয়ে নি:স্ব হয়ে বাড়ি ফিরতেও হচ্ছে।

কেউ কেউ চিকিৎসা করাতে এসে নকল স্বর্ণের বার কিনে শেষে টাকার অভাবে চিকিৎসা না করিয়েই আবার বাড়ি ফিরতে খালি হাতে। কিন্তু এসব প্রতারকচক্রের দৌরাত্ত কমছে। বরং বেড়েই চলেছে রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার প্রতারক চক্রের তিন হোতার কারণে। কারণ তাদের বাড়িতেই তৈরী হচ্ছে নকল স্বর্ণের বার। যেখানে সিল মারা থাকছে সৌদি আরবের।

এসব প্রতারণার ফাঁদ ও কাশিয়াডাঙ্গার তিন হোতা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘স্বর্ণের বারের ফাঁদে ফেলে মাঝে মাঝে এমন প্রতারণার ঘটনা নগরীতে ঘটছে। আমরা কয়েকজন রিকশা চালককে এরই মধ্যে আটকও করেছি। কিন্তু তার পরও এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। তবে কাশিয়াডাঙ্গার তিন মূল হোতা সম্পর্কে জানা নাই।

এক প্রশ্নের জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘যারা এই নকল স্বর্ণের বার তৈরীর সঙ্গে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার এই তিন হোতার বাড়িতেই বিশেষ কায়দা তৈরী হয় নকল স্বর্ণের বার। এদের তিনজনের বাড়িতেই পিতল কেটে তাতে ডায়িসের মাধ্যমে বসানো হয় সৌদি আরবের সিল।


এরপর একটি সাদা কাগজের শ্রী জুয়েলার্স নামের একটি ভুয়া দোকানের নামের মেমোতে লিখে দেওয়া হওয়া হয়, শ্রী নিপেন বাবু স্বর্ণকার। আশা করি ভালো আছেন। বিশেষ কারণে যেতে না পারাইবৌদির হাতে ২ ভরি ওজনের সোনার থান পাঠালাম। আমার ভাতিজিরবিয়েতে জোড়া কানের দুলসহ একটি জয়মালা বানিয়ে দিবেন। বিশেষ কিছু লিখলাম না। সাক্ষাতে কথা হবে।’

  • এই ধরনের একটি ভুয়া চিঠি লিখে সেটি আবার স্বর্ণের দোকানে ব্যবহৃত গোলাপি কালারের কাগজে মুড়িয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় রিকশা অথবা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালকদের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নকল স্বর্ণের বার পকেটে নিয়ে প্রতারক চক্রের সদস্য ওই চালকরা নগরীর রেলগেট এলাকায় অথবা শিরোইল বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে নগরীর বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের ওঠানোর জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। বাইরের সহজ-সরল যাত্রীরা ওইসব রিকশা বা অটোরিকশাতে ওঠার পরে কিছু দূরেই গিয়েই চলন্ত অবস্থায় রাস্তার মাঝে কাছে থাকা নকল স্বর্ণের বারটি কাগজে মোড়ানো অবস্থায় চালকরা ফেলে দেয় কৌশলে। এরপর দ্রুত রিকশা বা অটোরিকশা থেকে নেমে সেগুলো সেটি আবার কুড়িয়ে নিয়ে ওই প্রতারক চালক।

  • কুড়িয়ে নেওয়ার পরে যাত্রীর সামনেই সেটি গোলাপি কাগজের মোড়ানো মোড়কটি খুলে ফেলে। এরপর তার ভিতর থেকে নিপেন বাবু স্বর্ণকারের নামে পাঠানো ভুয়া ওই চিঠিটি যাত্রীকে পড়তে দেই চালকরা। এসময় চালকা দাবি করে, ‘আমি পড়তে পারি না, একটু পড়ে দেখেন তো লিখা আছে এখানে।’ ওই যাত্রীরা কাগজে মোড়ানো লিখা দেখে জানতে পারে, তার মধ্যে দুই ভরি ওজনের স্বর্ণের বার কে যেন নিপেন বাবু নামের এক ব্যক্তির কাছে পাঠিয়েছে।

ওই লিখা যাত্রীদের নিকট থেকে পড়ে শোনার পরে প্রতারক সেই চালক তখন যাত্রীর কাছে বাইনা ধরে বলতে থাকে, ‘আমি এতো সোনা কি করবো। আমি গরিব মানুষ। এই সোনা নিয়ে গেলে হয়তো মানুষ আমাকে সন্দেহ করবে। তাই কিছু টাকা দিয়ে যদি সোনাটি আপনি কিনে নেন, তাহলে তার সেটিই আমার লাভ হবে।’

এভাবে কৌশলে সহজ-সরল যাত্রীদের নিকট ওই নকল সোনার বারটি বিক্রি করে প্রতারক চালকরা। এর মাধ্যমে কোনো যাত্রীদের নিকট থেকে ১০-১৫ হাজার বার তার চেয়েও বেশি টাকা আদায় করে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক-দেড় হাজার টাকা অর্থাত যে যা শেষ পর্যন্ত দিতে চান, তাতেই রাজি হয়ে নকল স্বর্ণের বার বিক্রি করে কেটে পড়েন ওই চালক।

  • স্বর্ণের এই বারের নেপথ্যের নায়কদের নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধান চলাকালীন সময়েই গত সোমবার সন্ধ্যায় নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় হাতেনাতে ধরা পড়া এক প্রতারক চালক। নগরীর কাদিরগঞ্জ মসজিদের কাছে হযরত আলী নামের ওই প্রতারককে ধরেন স্থানীয়রা।

রিকশায় এক ছাত্রকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি প্যাকেটে মোড়ানো নকল সোনা কৌশলে ফেলে দিয়ে আবার সেটিকে কুড়ে নিয়ে ওই ছাত্রের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু স্থানীয়রা বিষয়টি টের পেয়ে ওই রিকশা চালককে ধরে পেটাতে থাকে। তার নাম রহিম বক্স। বেদম পেটানোর পরে অবশ্য ওই রিকশা চালককে ছেড়ে দেন স্থানীয়রা। নিজের সচেতনতা এবং স্থানীয়দের কারণে প্রতারণার হাত থেকে ওই যাত্রায় রক্ষা পায় সেই ছাত্র।

তবে হযরত আলী নামের ওই প্রতারক চালক জানায়, নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার আমজাদ হোসেন, মাসুদ এবং খোকন হলো এই চক্রের মূল হোতা। তাদের নিকট থেকেই নকল স্বর্ণের বার ৫০০ টাকা করে কিনে এনে রাস্তার মধ্যে ফেলে দিয়ে ওই চালক গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল মানুষদের নিকট প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রি করে আসছিল। এভাবে প্রায় দুই বছর ধরে হযরত আলী এ ব্যবসা করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত গত সোমবার সন্ধ্যায় ধরা পড়ে স্থানীয়দের হাতে।

তবে গত দুই বছরে প্রতারক হযরত অন্তত ৫ লাখ টাকা কামিয়েছে বলে স্বীকার করে এই প্রতিবেদকের কাছে।

  • ওই প্রতারককে ধরে মারপিট করার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহফুজুর রহমান লোটন। তিনিও কয়েক থাপ্পড় মারেন প্রতারক রিকশা চালক হযরত আলীকে।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দিনের পর দিন এভাবে নকল সোনা রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে একটি চক্র। নগরীতে এদের উপদ্রুব এতোই বেড়েছে যে, গ্রামের সাধারণ মানুষরা প্রতিদিন এদের খপ্পরে পড়ে স্ববর্স্ব খোয়াচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে করে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।’

  • অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, নকল স্বর্ণের বার চক্রের হোতারা বাড়িতে ছেউনি দিয়ে পিতল কেটে ডায়িসের ওপরে রেখে তাতে সৌদি আরবের সিল বসিয়ে দেয়। এরপর সিরিস কাগজে সেই পিতল ঘুঁষা-মাজা করে স্বর্ণের বারের আকার দেওয়া হয়।

সেটিই রিকশা এবং অটোরিকশা চালকরা এসে দিনের বেলা অথবা রাতে এসে গোপনে কিনে নিয়ে যায়। এভাবে ওই এলাকার গুচ্ছ গ্রামের খোকন এবং মাসুদও একই কায়দা দীর্ঘদিন ধরে নকল স্বর্ণের বারের ব্যবসা করে আসছে। আর সেগুলো কিনে নিয়ে এসে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসে থাকছে ওই চালকরা।

এই চালকরা সবচেয়ে বেশি ফাঁদ পেতে বসে তাকে সকালের দিকে। দূর-দূরান্ত থেকে যেসব সহজ-সরল মানুষ রাজশাহীতে আসেন চিকিৎসা করাতে বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-লেখার জন্য, তাদেরকেই টার্গেট করে মাঠে নামে এই চক্রের সদস্যরা।

গত শুক্রবার সকালেও নগরীর বর্ণালীর মোড়ে এমন প্রতারণার শিকার হোন কুষ্টিয়া থেকে রাজশাহীতে চিকিৎসা নিতে এক দম্পতি। প্রতারণার শিকার আলমগীর হোসেন নামের ওই ব্যক্তি স্থানীয়দের কাছে জানিয়েছিলেন, নকল স্বর্ণের বার বিক্রি করে তার নিকট থেকে চিকিৎসা করানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে আসা ৬ হাজার টাকা কৌশলে নিয়ে চলে গেছে একজন অটোরিকশা চালক। পরে স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, সেটি পিতলের বার। স্বর্ণের নয়। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা না করিয়েই আবার বাড়ি ফিরতে হয় আলমগীর এবং তার স্ত্রী সুরাইয়াকে।

স/আর