পোশাক-ছবিই এখন স্মৃতি রাকিবের মায়ের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘আমি এহনও অনেক রাইতে চোখ বুজাইতে পারি না, তা ওইলে রাকিবের কান্না হুনতে পাই। কতো কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে বাবা আমার মইরে গেছে’।

মঙ্গলবার (০২ আগস্ট) খুলনা মহানগরীর টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের ভাড়া বাসায় গেলে আবেগ আর কান্না জড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন পৈশাচিক নির্যাতনে নিহত শিশু রাকিবের মা লাকী বেগম। ছেলের ছবি ও পোশাক বুকে নিয়ে কষ্ট আর বেদনায় এখন জীবন কাটে তার।

 

গত বছরের ০৩ আগস্ট বিকেলে টুটপাড়া কবরখানা মোড়ের শরীফ মোটরসের মালিক শরীফ মোটরসাইকেলের কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে শিশুশ্রমিক রাকিবের পায়ুপথে হাওয়া ঢুকিয়ে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিলেন। তার অপরাধ ছিল, কর্মস্থল পরিবর্তন করে অন্যত্র যাওয়া।

 

এমন বীভৎসতায় শিহরে উঠেছিলেন গোটা দেশবাসী। ক্ষোভে, বিক্ষোভে আর  ঘৃণায় তিনমাস তারা রাজপথ উত্তপ্ত রেখেছিলেন। বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডটি সবার কাছে ছিল বিস্ময়কর ঘটনাও।

ঘটনার পরদিন রাকিবের বাবা মো. নুর আলম বাদী হয়ে শরীফ, শরীফের মা বিউটি বেগম ও চাচা মিন্টু খানের বিরুদ্ধে সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। গত বছরের ০৮ নভেম্বর মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামি শরিফ ও মিন্টুকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিউটি বেগমকে বেকসুর খালাস দেন। মামলাটি আপিল আকারে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

 

বুধবার শিশু রাকিবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

 

কেটে গেছে একটি বছর। থামেনি মায়ের কান্না, বাবার আহাজারি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় তাদের, হু হু করে কেঁদে ওঠেন।  বাবা-মায়ের সঙ্গে কেঁদে ওঠে রাকিবের একমাত্র বোন রিমিও।

 

স্বাভাবিক জীবনেও ফিরতে পারেনি পরিবারটি। অনুদানে পাওয়া রিকশাটিই বাবা নূর আলমের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। মা লাকী বেগম ফিরেছেন বাসা-বাড়ির কাজে। ছোট বোন রিমি করোনেশন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী।

 

নূর আলম জানান, রাকিবের মৃত্যুর পর পাওয়া রিকশা চালাতে অনেক কষ্ট হয়। পথে পথে যাত্রী ওঠা-নামা করার পাশাপাশি টুটপাড়া কবরখানা সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় চিরনিদ্রায় থাকা বুকের মানিকের কবরটা দেখতে ছুটে যান।

 

রাকিবের মা জানান, অভাবের তাড়নায় ওকে লেখাপড়া ছেড়ে কাজে নামানো হয়েছিলো। তার আয় দিয়েই সংসারের অর্ধেক চলতো।

 

বিলাপ করে তিনি বলেন, ‘এখন আর কেউ বলে না, মা ক্ষুধা পেয়েছে খাবার দাও’।

 

ছোট বোন রিমি বলে, ‘ভাইয়াকে খুব বেশি মনে পড়ে। তাই ওর ছবি দেখি। আগে ভাইয়ের সঙ্গে কতো মজা করতাম’।

 

‘রাকিব হত্যার পর অনেকেই অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি’- চাপা ক্ষোভ নিয়ে এমনটিও বললেন রাকিবের মা ও বাবা।

 

তারা জানান, বিভাগীয় কমিশনার মাথা গোজার ঠাঁই হিসেবে জায়গা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক বছরেও তা আর হয়নি। জেলা পরিষদের প্রশাসক হারুনুর রশিদ মেয়ে রিমিকে সরকারি করোনেশন স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলের বড় ম্যাডাম ৬ মাসের বেতন একসঙ্গে নিয়েছেন। রিমি দু’টি কোচিংয়ে পড়ে। তার মধ্যে আরএস কোচিংয়ে মাসে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়।

 

অনেকেই মেয়ের পড়ালেখার খরচ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখেননি। এখন অর্থের অভাবে মেয়ের পড়াশোনা করানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলেও জানান নূর আলম-লাকী দম্পতি।

 

অসহায় বাবা-মা বলেন, ‘প্রায়ই খুনিদের লোক এসে প্রস্তাব দেন,  ৫ কাঠা জমির বিনিময়ে আমরা যেন মামলা তুলে নেই। কিন্তু আমরা তাদের বলেছি, তোমরা ৫ কাঠা দিলে আমরা রাকিবের বিনিময়ে তোমাদের ১০ কাঠা দেবো। তোমরা পারবা, রাকিবকে ফিরিয়ে দিতে?’

 

‘কোনোভাবেই যেন খুনিরা পার না পায়। দ্রুত যেন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তদের শাস্তি হলে রাকিবের আত্মা শান্তি পাবে’- বলে কেঁদে ফেলেন মা-বাবা।

 

বাদীপক্ষের আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম জানান, এ মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হলেও হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসেনি।

 

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৌহিদুর রহমান তুষার বলেন, ফাঁসির আদেশ পাওয়া শরীফ ও মিন্টু মিয়া যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে রয়েছেন।

সূত্র: বাংলা নিউজ