পোল্যান্ড সীমান্ত চেকপোস্টেই ১০-১৫ ঘন্টা, ভোগান্তি ইউক্রেনের পথে পথে


রফিকুল ইসলাম :

গত বৃহস্পতিবার (২৩ ফ্রেব্রুয়ারি) সকাল ১০ টার দিকে ইউক্রেনের ওডেসা শহর থেকে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী রাহাত আলী। এর পর বাংলাদেশে সমমূল্যের প্রায় ৭০ টাকায় একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ী ভাড়া করে বাংলাদেশী তিনজনসহ অন্যান্য দেশের সাতজন মিলে রওনা দেন প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার দূরে পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে। ওডেসা থেকে প্রায় ২৩ ঘন্টায় প্রায় ৬২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন ওই গাড়ীতে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় এ ধরনের গাড়ীতে ওডেসা থেকে লিভিভে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সময় ব্যয় হত ৮ ঘন্টা।

রাহাত জানান, তাদের গাড়িটি ইউক্রেনের লিভিভ-পোল্যান্ড এম১১ সীমান্ত বর্ডারের প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে এসে থেমে যায়। এর পর ৫ ঘন্টা ধরে পায়ে হেঁটে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে শুক্রবার দুপুরে পোল্যান্ড সীমান্তের এম১১ বর্ডারে এসে পৌঁছান ওই সাতজন। এছাড়াও আরও কয়কেকটি গাড়ীতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওডেসা থেকে একই সময়ে বর্ডারে এসে পৌঁছান আরও ৬ বাংলাদেশী ছাত্র। এই বর্ডারে আসার পরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয় তাঁদের৷ লাইন থেকে কেউ কোনো প্রয়োজনে একবার বের হলেই মুহূর্তেই শত শত মানুষের পেছনে পড়ে যেতে হচ্ছিলো। ফলে বাধ্য হয়ে কোনো খাবার বা পানি পান ছাড়ায় লাইনে ইমিগ্রেশনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন রাহাতসহ অন্যদের। শেষ পর্যন্ত ১০ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে চারটার দিকে ইমিগ্রেশন শেষ করে পোল্যান্ডের মাটিতে পা ফেলতে পারেন রাহাতসহ ওই সাতজন।

রাহাতের সঙ্গী আরেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থী রুম্মান আলী বলেন, ‘কখন এসে বোমা মাথায় পড়বে সেই আতঙ্ক মাথায় ছিলো। কিন্তু তার চেয়ে বড় কষ্ট পেয়েছি খাবার আর পানি সঙ্কটে। টাকার ওভাবে অতিরিক্ত দামে খাবার কিন্তেও পারিনি। যে কয়েকটি দোকানপাট খোলা আছে তার মধ্যে অধিকাংশ দোকানই কার্ড থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রবাসীরা সবাই কার্ডেই লেনদেন করেন বেশি। এই অবস্থায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত অনেকটা না খেয়েই প্রায় ৫০ ঘন্টা পার করতে হয়েছে আমাদের। আবার এম১১ বর্ডারের ১০ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে প্রায় পানিশূন্য অবস্থায়। টয়লেটে গেলেই লাইন থেকে ছিটকে পড়লে আবার ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে এই ভয়ে পানিই খাননি অনেকে। এতে আমরা সবাই শারীরিকভাবে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তার পরেও ভাগ্য সহায় ছিলো বলে পোল্যান্ডে এসে পৌঁছাতে পেরেছি।’

জামান হোসেন নামের আরেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখনো শত শত বাংলাদেশি রাস্তায় বা সীমান্ত বর্ডারে ইমিগ্রেশনের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকেই রাস্তার মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে তীব্র ঠান্ডায় কেউ কেউ হাইপোথার্মিয়িতেও ভূগছেন বলে ইউক্রেনের বাংলাদেশ কমিউনিটি ওহয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখেছেন অনেকেই। তার পরেও নানা কষ্ট সহ্য করে ইউক্রেন থেকে ছুটে আসছেন পোল্যান্ডে। হাজার মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে পোল্যান্ড সীমান্তের বিভিন্ন সীমান্ত চৌকিতে এসে ভীড় করছেন। যার কারণে বর্ডারের কোথাও কোথাও ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে এসেই আটকে যাচ্ছে গাড়ি। এর পর পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হচ্ছে সেই পথ।’


আকবর আলী নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান, বাংলাদেশী প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী থাকেন ইউক্রেনের ওডেসা শহরে। সেখানকার সময় বৃহস্পতিবার ভোরে রাশিয়া বোমা বিস্ফোরণ শুরু করার পর সকাল থেকেই যে যার মতো দল বেধে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে পোল্যান্ডের দিকে ছুটতে থাকেন। তবে রাস্তায় বা ইমিগ্রেশনের জন্য এখনো অন্তত সহস্রাধিক বাংলাদেশী আটকা পড়ে আছে৷ আবার অনেকেই এখনো রওনা দিতেই পারেননি যানবাহনের সঙ্কটে। ফলে যারা এখনো পৌঁছাতে পারেননি তারা চরম দুর্ভোগ আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।’

মাহে আলম নামের একজন প্রবাসী বাংলাদেশী ইউক্রেনের লিভিভ শহরে চিকিৎসায় পড়া-শোনা করে তিনি সেখানেই চোক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পেশাজীবন করেন। এর পর সেখানেই বাংলাদেশী লাকি নামের একজনকে বিয়ে করে সংসার পাতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও মাহে আলম ইউক্রেন ছাড়তে রাজি ছিলেন। কারণ তাঁর দুই ছেলে-মেয়েও সেখানেও পড়া-শোনা করেন। অগত্য বাধ্য হয়ে গতকাল রবিবার ভোরে তিনি লিভিভ থেকে পরিবার নিয়ে পায়ে হেঁটে কার্কোভেতস সীমান্ত চৌকি এলাকায় গিয়ে পৌঁছান।

বাংলাদেশ সময় গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মাহে আলম বলেন, ‘অনেক কষ্টে পায়ে হেঁটে সীমান্তে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু বর্ডারে হাজার হাজার মানুষের যে ভীড় এবং অবব্যস্থাপনা তাতে কখন নাগাদ পোল্যান্ডে পৌঁছাবো তা ঠিক বলতে পারছি না। শুনেছি আমার আগে এক-দুই দিন ধরে অপেক্ষা করছেন কেউ কেউ সীমান্ত পার হওয়ার জন্য।’
স/আর