পেশা হিসেবে কি সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটতে চলেছে?।। কাজী শাহেদ :

 

গত ১৫ দিনে দুই দফা জাতির উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। ভাষণের পুরোটা জুড়ে করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য নানা সুবিধার প্রতিশ্রুতি। গার্মেন্ট কীভাবে টিকবে, তাদের প্রণোদনা দিয়ে কীভাবে রক্ষা করা যায়-সবই ছিল ভাষণে। আশান্বিত হয়েছেন গার্মেন্ট পেশায় নানাভাবে জড়িত কোটি মানুষ। এরপর কৃষক, রিকশাচালক, নিম্নআয়ের মানুষদের জন্যও ৭০০ কোটি টাকার প্রণোদনা। কিন্তু কোথাও, কোনোভাবেই দেখা পেলাম না গণমাধ্যমের জন্য কোনো খবর। গণমাধ্যমে জড়িত বিপুল পরিমাণ মানুষের জন্য নেই কোনো আশার খবর।

‘ইজ জার্নালিজম ডায়িং?’এই বাক্যটা গুগল সার্চ ইঞ্জিনে লিখে ফলাফলের দিকে তাকালাম। এক সেকেন্ডে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ লিঙ্কের পথ দেখাল গুগল। এ থেকে বোঝা যায়, সাংবাদিকতার অস্তিত্বের সংকট কী ব্যাপক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংকট এত গুরুতর যে ‘মৃত্যু’ শব্দটাই ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রশ্ন জাগছে মনে, পেশা হিসেবে কি সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটতে চলেছে?
কিন্তু কেন এই প্রশ্ন জাগছে মনে? সাংবাদিকতার কি মৃত্যু হতে পারে? তাহলে গণতন্ত্রের কী হবে? রাষ্ট্রশাসনে, ক্ষমতার ব্যবহারে, আইন প্রয়োগে, জনগণের করের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির কী হবে? রাজনৈতিক অধিকার, মানবিক অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, তথ্য জানার অধিকার-এসবের কী হবে? মোট কথা, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা ছাড়া পৃথিবী চলবে কী করে?

বিএফউজের মহাসচিব শাবান মাহমুদ ণিখেছেন, ‘মহাসচিব হিসেবে এই মুহূর্তে আমার দায়িত্ব অনেক। সম্মানিত সদস্যরা প্রতিনিয়ত আমার কাছে জানতে চান, এই দুর্যোগ এবং সংকটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অসহায় গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য কিছু করবেন কিনা? জবাব দিতে পারি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই গণমাধ্যম বান্ধব প্রধানমন্ত্রী। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নীরবে বসে থাকতে পারেন না। এই বিশ্বাস থেকেই গতকাল মাননীয় তথ্য মন্ত্রীসহ সরকারের সর্বোচ্চ মহলে কথা বলেছি। বিএফউজের সভাপতি মোল্লা জালাল ভাই এবং ডিইউজের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ভাই এবং সাধারণ সম্পদক সাজ্জাদ আলম খান তপু সমানতালে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি যতদূর সরকারের পক্ষ থেকে আভাস পেয়েছি তা অনেকটা ইতিবাচক। আশা করি আগামী সপ্তাহে একটা সুখবর পাবো। সবার জন্য শুভ কামনা ..’।

কিসের সুখবর পাওয়া যাবে সেটি কিন্তু খেলাসা করেননি মহাসচিব। যারা এখনো মাসের বেতনটা পাননি-তারা কি বেতনটা পেয়ে যাবেন? করোনা অজুহাতে যেসব গণমাধ্যম মালিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে আমাদের বহু সহকর্মীকে বেকার করে দিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কি খুলে যাচ্ছে? সুদিন ফিরছে আমার অগ্রজ ও অনুজ সহকর্মীদের? যদি তা না হয়-তাহলে কিসের সুখবর।
সরকারের কাছ থেকে মালিকরা নানা অজুহাতে সুবিধা নিয়েছেন। আমি যতোটা জানি করোনার কারণে বিজ্ঞাপন আসছে না, পত্রিকার বিক্রি কমেছে, আয় কমেছে, কর্মীদের বেতন দিতে পারছেন না-এমন কথা সরকারকে বলে মোটা অংকের অর্থ নেয়ার তদবির চলছে। তাহলে এতোদিন যারা আয় করে ব্যাংকে পুড়েছেন, বাড়ি-গাড়ি করেছেন সেগুলোর ভাগ কি সরকার চেয়েছে? তাহলে এই অজুহাতে সরকারের কাছ থেকে টাকা দাবির মানেটা কি?

সাংবাদিকতার মৃত্যুতুল্য সংকটের সঙ্গে এই সব প্রশ্নসহ আরও হাজার প্রশ্ন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই খতিয়ে দেখা দরকার, কেন ও কী পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিকদের ‘পৃথিবীর নিকৃষ্টতম জীব’ বলে গালি দিচ্ছেন স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। দেশে দেশে এমন সব কঠোর কালাকানুন জারি করা হচ্ছে, যার বলে সাংবাদিকদের কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে কারাগারে আটকে রাখা যায়; জব্দ করা যায় প্রকাশনার সরঞ্জাম। এমনকি সাংবাদিকদের গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগেও বিচার করে শাস্তি দেওয়ার আইনি হাতিয়ার আমদানি করা হয়েছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রসারের ফলে তথ্য, খবর ও মতামত বিনিময় এখন আর শুধু সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; সাংবাদিকতার সঙ্গে লেশমাত্র সম্পর্ক নেই, এমন মাধ্যমেও চোখের পলকে এই সবকিছুর আদান-প্রদান সম্ভব হচ্ছে। পশ্চিমা জগতের সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যম শিল্পে এই চ্যালেঞ্জই সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। একসময়ের ডাকসাইটে সংবাদপত্র ও টিভি স্টেশনগুলোর আয় এত দ্রুত গতিতে কমে গেছে যে তারা এখন অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি। ২০০৫ সালের পর এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর সব বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠান লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার একসময়ের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম নিউইয়র্ক টাইমস ২০০৬ সালে আয় করেছিল ২১৫ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার মার্কিন ডলার; ২০১৫ সালে তার আয় কমে গিয়ে নামে মাত্র ৬৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ডলারে।

আমেরিকার আরেক শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট-এর দুর্দশা হয়েছে আরও মর্মান্তিক। মালিকরা লোকসান টানতে না পেরে পত্রিকাটি বিক্রি করে দিয়েছেন; সেটা কিনে নিয়েছেন আমাজনের ধনাঢ্য মালিক জেফ বেজোস। কিন্তু তিনিও পত্রিকাটির লোকসান থামানোর পথ খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে বৃটেনের অন্যতম মর্যাদাবান দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর ছাপা সংস্করণের মৃত্যু ঘটেছে। এখন শুধু অনলাইন সংস্করণ টিকে আছে; এই পরিণতি ঘটার আগে পত্রিকাটির মালিকানা বদল হয়েছে একাধিকবার। সবশেষে এটি কিনে নিয়েছেন এক ভুঁইফোড় রুশ ধনকুবের। লোকসান কমানোর উদ্দেশ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সাংবাদিককে ছাঁটাই করেছেন; কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। এভাবে তিনি এটা কত দিন চালাবেন, বলা কঠিন।

ব্যাপার হলো, সংবাদ পাওয়ার জন্য লোকজনকে এখন আর শুধুই সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না; তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো থেকে সবই পাচ্ছে। সংবাদপত্র ও টিভি কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া। তারা আগে যেসব বিজ্ঞাপন পেত, এখন সেগুলো পাচ্ছে ফেসবুক, গুগল, আমাজন ইত্যাদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যারা সাংবাদিকতা করে না। যেকারণে প্রশ্ন জাগছে মনে, পেশা হিসেবে কি সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটতে চলেছে?

লেখক : সভাপতি, রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন