পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠেলাঠেলি: ছাত্রলীগের হামলায় আহত তরিকুলের স্বপ্ন ঝাঁপসা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাবি:
এখনও ঠিকভাবে হাঁটতে পারেন না। ক্রাচে ভর দিয়ে কোন রকম দাঁড়াতে পারেন। একটু হাঁটলেই পায়ে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। ক্ষতস্থান থেকে মাঝে মধ্যে পুঁজও বের হয়। দিন কাটছে শুয়ে বসেই। এতে স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেছে তার। পিছিয়ে পড়েছেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকেও।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় আহত তরিকুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। তিন ভাইবোন আর মা-বাবা নিয়েই তরিকুলদের পরিবার। তিন ভাইবোনই পড়ালেখা করছেন। তরিকুল দ্বিতীয় সন্তান। স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন তিনি। সংসার চালানোর জন্য বাবার কৃষি কাজই একমাত্র মাধ্যম। রাজশাহীতে এসে অনেক জায়গায় টিউশনি খুঁজেও পাননি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় বাড়ি থেকে খুব সামান্য পরিমাণ অর্থ পেতো তরিকুল। তা দিয়েই কোন রকম পড়ালেখা ও থাকা-খাওয়া চালাতে হয় তাকে। শিক্ষাজীবন শেষ করেই পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। এজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি ওয়েব ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের হামলায় আহত তরিকুলের স্বপ্ন ঝাঁপসা হয়ে গেছে।

এমনকি আইনের সুস্পষ্ট বিচারও পাচ্ছেন না তিনি। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। হামলাকারীদের ব্যাপারে থানায় কোন অভিযোগ বা মামলা না থাকায় পুলিশও বিষয়টিতে মাথা ঘামাচ্ছেন না।

হামলাকারীদের ব্যাপারে ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে, ‍পুলিশ বলে বিশ্ববিদ্যালয় বতৃপক্ষ দেখবে আর বিশ্ববিদ্যায় কতৃপক্ষ বলে বিষয়টি পুলিশের দেখার কথা। এ নিয়ে চলছে একে আপরের ঠেলাঠেলি।

গত ২ জুলাই সরকারি চাকুরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের পূর্ব দিক থেকে পতাকা মিছিল বের করেন। কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তরিকুল। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ কর্মসূচিতে হামলা চালায়। হামলা থেকে বাঁচতে দৌঁড় দেন তরিকুল। দৌঁড়াতে গিয়ে পড়ে যান তিনি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তরিকুলের ওপর লাঠি, বাঁশ আর হাঁতুড়ি দিয়ে উপুর্যপূরী আঘাত করে। এতে তরিকুলের ডান পায়ের হাড় ভেঙে যায়। আঘাত পান কোমড়েও। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হাড় জোড়া লাগানোর জন্য তার পায়ে পাত বসানো হয়েছে।

২৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্স চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা। পায়ের সমস্যার কারণে স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষা দিতে পারছেন না তরিকুল। পরীক্ষার প্রথম দিন সহপাঠীদের সহযোগিতায় ক্রাচে ভর দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হন। বেশিক্ষণ একভাবে স্থির থাকতে পারেন না তিনি। তাই বিভাগের সভাপতির কক্ষে বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার জন্য। সেই বিছানায় কখনো বসে কখনো বা শুয়ে শুয়ে কোন রকম পরীক্ষা দিচ্ছেন। পরীক্ষা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যালের সিক বেডের জন্য আবেদনও করেন তরিকুল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি মেলেনি।

তরিকুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। ঘটনার দিন কোন ক্লাস পরীক্ষা না থাকায় নিজ কক্ষেই ছিলেন তরিকুল। দুপুরের পর পতাকা মিছিল শুরু হলে আন্দোলনে অংশ নেন তিনি।

সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক মাসুদ মোন্নাফ সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছাকাছি আসতেই আনুমানিক বিকাল ৪টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন দেশিয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তরিকুলকে একা পেয়ে তারা মারধর করে। পরে তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

সাতদিনেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৯ জুলাই তরিকুলকে ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখানে তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর তরিকুল বাড়িতে আসেন। এ বছর পরীক্ষায় বসবেন না বলে সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। কিন্তু সহপাঠীদের অনুরোধে পরীক্ষা দিতে রাজি হন।

ভয়াবহ সেই ঘটনা আজও চোখের সামনে ভাসে তরিকুলের। পায়ের দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন তিনি। মুঠোফোনে তরিকুল সিল্কসিটি নিউজের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার হাজার আকুতিতেও মন গলেনি হামলাকারীদের। তারা আমাকে আঘাত করতেই থাকে। কেউ মাথায়, কেউ বুকে, কেউ কোমড়ে আঘাত করে। একজন তো হাঁতুড়ি দিয়ে পা টাই ভেঙে দিলো।’

পায়ের সমস্যা, চিকিৎসার জন্য অর্থের জোগান, আশানুরূপ পরীক্ষা দিতে না পারা এসব মিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তরিকুল। তিনি বলেন, ‘পায়ের পাশাপাশি কোমরের ব্যাথার কারণে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। তিন মাস হয়ে গেলো। নিয়মিত ওষুধও খাচ্ছি। কিন্তু এখনও ব্যাথা আছেই।’

তরিকুলের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে মাসুদ মোন্নাফ বলেন, ‘তরিকুলের পায়ের হাড় পুরোপুরি ভাঙা ছিলো। অস্ত্রোপচারের পর পায়ের অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো। ডাক্তার বলেছে সুস্থ হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। বর্তমানে পরিবার ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় চিকিৎসার ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

এদিকে, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি ব্যবস্থা নিচ্ছে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি পুলিশের দেখার কথা।’

মতিহার থানার ওসি শাহাদত হোসেন বলেন, ‘হামলাকারীদের ব্যাপারে থানায় কোন অভিযোগ বা মামলা করা হয়নি। যেহেতু এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার, তাই তারাই ভালো জানেন।’

স/অ