পুলিশের সহযোগিতায় হত্যা: বিচার পায়নি মিলনের পরিবার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নে ডাকাত সন্দেহে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে পুলিশের সহযোগিতায় পিটিয়ে হত্যার ৫ বছরেও বিচার পাইনি তার মা কহিনুর বেগম। আজ বুধবার (২৭ জুলাই) এ হত্যার ৫ বছর পূর্ণ হল।

মিলন হত্যার ৪ বছরের সময় ২য় তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি-ডিবি মো. আতাউর রহমান ভূঁইয়া এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় শনাক্ত হওয়া চার পুলিশ সদস্যসহ মামলার ৩১ আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন। এ বিষয়ে গত ২০১৫ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি।

২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর নোয়াখালীর ২ নম্বর আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক ফারহানা ভূঁইয়া ডিবি-পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের উপর শুনানি শেষে প্রতিবেদনটি গ্রহণ না করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য নোয়াখালীর সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সে নির্দেশের ৯ মাস কেটে গেলেও তদন্ত সিআইডি কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহমেদ এখন পর্যন্ত তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ২-১দিনের মধ্যে আদালতে তদন্ত  রির্পোট জমা দেয়া হবে।

নিহত মিলনের মা ও মামলার বাদী কহিনুর বেগম বলেন, ‘সিলেটের রাজন হত্যার বিচার হলেও আমার ছেলে মিলন হত্যার বিচার ৫ বছরেও আমি পায়নি। মামলাটি তুলে নিতে পুলিশ তার ছোট ছেলে সালাউদ্দিন পাভেলকে চাকরি দেয়ার জন্য নোয়াখালী জেলা সদরে তিনবার নিয়েছে। কিন্তু মাপের অজুহাত দেখিয়ে পাভেলকে উচ্চতায় আধা ইঞ্চি কম বলে পুলিশের চাকরিতে নেয়নি। এরপর অন্য একটি চাকরি দেবে বলে আমাকে আবারও আশ্বাস দিয়েছে।’

মিলনের মা কহিনুর বেগম আরো বলেন, ‘ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতের বারান্দায় অনেক ঘুরেছি। ডিবি পুলিশের কাছে অনেক বার গিয়েছি। আদালত থেকে ৫২ বার সময় নিয়েও ডিবি পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়নি। ডিবি পুলিশ ও আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে চার বছর যাবত আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিন্তু বিচার পাইনি। এখন আমার একটাই চাওয়া সন্তান হত্যার বিচার ও সংসার চালানোর জন্য ছোট ছেলে সালাউদ্দিন পাভেলকে একটি চাকরি দেয়া।’

প্রসঙ্গত, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নের বিক্ষুব্ধ লোকজন ২০১১ সালের ২৭ জুলাই ছয় ডাকাতকে পিটিয়ে হত্যা করে। কিশোর মিলন ওইদিন সকালে চরফকিরা গ্রামের বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে যাচ্ছিলেন। পথে চরকাঁকড়া একাডেমি স্কুলের সামনে থেকে একদল লোক তাকেও ডাকাত সন্দেহে আটক করে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়।

পুলিশ মিলনকে থানায় না নিয়ে ডাকাত সাজিয়ে চরকাঁকড়া ইউনিয়নের টেকের বাজারে তিন রাস্তার মোড় নামক স্থানে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেয়। এরপর স্থানীয় লোকজন নিরপরাধ কিশোর মিলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। তার কাছ থেকে নগদ ১৪ হাজার টাকা ও একটি দামী মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

ঘটনার কয়েকদিন পর হত্যাকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও সহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশ হলে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। অভিযুক্ত চার পুলিশকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়।

২০১১ সালের ৩ আগস্ট মিলনের মা কহিনুর বেগম বাদী হয়ে নোয়াখালীর ২ নম্বর আমলী আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে ওই বছরের ৮ আগস্ট কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলাটি এফআইআর হিসেবে রুজু করে পুলিশ। মিলন হত্যার সময় ওসি রফিক উল্যাহ, ঘটনার স্থলে উপস্থিত থাকা এসআই আকরাম উদ্দিন শেখ, কনস্টেবল হেমা রঞ্জন চাকমা ও আবদুর রহিমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকৃতরা কিছুদিন পর আবার স্ব-স্ব পদে ফিরে যান।

মিলন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১১ সালের ৬ আগস্ট কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই আকরাম উদ্দীন শেখ, কনস্টেবল আব্দুর রহিম ও হেমা রঞ্জন চাকমাকে বরখাস্ত করেন পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন উর রশিদ হাযারী। একই সাথে ঘটনার তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব রশিদ, সহকারী পুলিশ সুপার আলী হোসেন এবং নোয়াখালীর ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিল্লাল হোসেনের সমন্বয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন এসপি।

নোয়াখালীর ডিবি পুলিশ হত্যার ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকায় চিহ্নিত স্থানীয় ৭ জনকে আটক করলেও এ ঘটনার মূলহোতা পুলিশ সদস্য কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই আকরাম উদ্দীন শেখ, কনস্টেবল আব্দুর রহিম ও হেমা রঞ্জন চাকমাসহ পুলিশ সদস্যদের অদৃশ্য কারণে আটক করেনি।

কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তৎকালীন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি রফিক উল্ল্যাহ, এসআই আকরাম উদ্দীন শেখ, কনস্টেবল আব্দুর রহিম ও হেমা রঞ্জন চাকমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মধ্যে তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।

প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে থানা পুলিশ। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় নোয়াখালী জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে। ২০১৫ সালে ডিবি পুলিশের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাদী মামলা চালাতে চান না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে বর্ণিত ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও কে বা কারা উক্ত ঘটনা করেছে তা প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় মামলাটি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে মামলাটি প্রমাণ করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে বলে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান ভূঁইয়া ভিডিওচিত্র দেখে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত ২৭ জন এবং এ ঘটনায় অভিযুক্ত ওসি রফিকসহ ৪ পুলিশ সদস্যের মামলার দায় হতে অব্যাহতির আবেদন করেন সংশ্লিষ্ট আদালতে। এ মামলার সকল আসামি বর্তমানে জামিনে রয়েছে।

সূত্র: বাংলামেইল