পুঠিয়ায় অবৈধ পুকুর ও অকেজো স্লুইচগেটে জলাবদ্ধতায় হুমকিতে ২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি

মইদুল ইসলাম মধু, পুঠিয়া:

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় অবৈধভাবে পুকুর খনন ও অপরিকল্পিত ক্রসড্রাম ও স্লুইচগেট নির্মানে প্রায় ২ হাজার হেক্টর ফসলি জমির পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। এতে উপজেলার কয়েকটি বিলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষকরা আশঙ্কা করছেন দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা না হলে চলতি মৌসুমে উপজেলার দুটি ইউনিয়নের অন্তত দুই হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে ইরি ও বোরো চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

এ দুটি ইউনিয়ন ছাড়াও আরো বাঁকী চারটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় ধানী জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য অবৈধ পুকুর খনন করা হয়েছে। এতে যেমনি পানি নিষ্কাশন ব্যহত হচ্ছে তেমনি ফলসি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বানিজ্যিকভাবে পুকুর চাষ করায় বিপুল পরিমানের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুকুরগুলো খনন করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও পেশাদার মাছচাষীরা। দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরশনে ৭ দফা দাবীতে কৃষকদের পক্ষে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হলেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ফলে হতাশ কৃষকরাও।

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার জিউপাড়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া কান্দার বিল, মধুখালী ক্যাকলি কান্দার বিল এবং নাটোরের ডুবের বিল এই তিনটি বিলের পানি প্রথমে পাইটকী বাড়ী বিলে জমা হয়। জমাকৃত এসব পানি পাকার বিলে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করায় পানি নিষ্কাশন ব্যহত হয় ফলে ওই তিন টি বিলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

জিউপাড়া ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, গাঁওপাড়া বারঘরিয়া ও সেনভাগ বিলের পানি প্রথমে জমা হয় ম্যাচপাড়া বিলে সেখান থেকে পুঠিয়া ও নাটোরের সীমান্ত এলাকা শৈলধুপরি বিল হয়ে পাকার বিলে যাওয়ার কথা থাকলেও দুদাঁড়ি নামক স্থানে অপরিকল্পিত পুকুর খননে পানি বাঁধাগ্রস্থ হয়ে ওই এলাকাসমুহে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে সময় মত কৃষকরা ফসল ফলানো ও উত্তোলনে বাঁধার মুখে পরে।

কৃষকদের সংগঠন জাতীয় কৃষক সমিতির পুঠিয়া শাখার সাধারন সম্পাদক সারদিউল্লাহ জানান, উপরে উল্লেখিত ৫ টি বিলের পানি পাকার বিলে জমা হওয়ার কথা থাকলেও দহের পাড় নামক জায়গায় অপরিকল্পিত পুকুর খনন করায় এবং তার প্রায় ২০০ গজ দুরে অকেজো অবস্থায় একটি ক্যানেল থাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, দ্রুত সেখানকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা গেলে প্রায় ৪০০ একর জমিতে ধানের বীজ বপন করা সম্ভব হবে পরেছে। এছাড়াও জিউপাড়া ইউনিয়নের বিলমাড়িয়া বিলের মাঝখানে একটি অকেজো অবস্থায় কালভাট রয়েছে ফলে ওই বিলের পানিও নিষ্কাশন বন্ধ রয়েছে।

এদিকে ঝলমলিয়া ইটিকোরার বিল ও হিজলতলা বিল থেকে জিউপাড়া কান্তার বিল এ তিনটি বিলের পানি মুসাখাঁ নদীতে পতিত হয়। অথচ কান্তার বিল হয়ে মুসাখাঁ নদীতে পানি প্রবেশের ক্যানেলটি অকেজো হয়ে থাকায় এবং দীর্ঘদিন যাবত এটি সংস্কার না হওয়ায় উক্ত বিলসমুহে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে এতে মুসাখাঁ নদীও তার নাম্ব্যতা হারাচ্ছে।

সংগঠনটির সভাপতি আবদুর রউফ বলেন, উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন ও ভালুকগাছি ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত ক্রসড্রাম নির্মানের ফলে বিলসমুহের পানি নিষ্কাশন হুমকির মুখে রয়েছে। ফলে সেখানে অবশ্যই পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা দরকার। এছাড়াও ভালুকগাছি ইউনিয়নের কান্তার বিলের পানি পানানগর ক্যানেল হয়ে তাহেরপুর বারনয় নদীতে প্রবাহিত হওয়ার কথা অথচ কান্দার বিলে অপরিকল্পিত ভাবে বিলের মাঝখানে অবৈধ পুকুর খনন করায় এবং ইউনিয়নের পানানগর এলাকায় ৭ বছর যাবৎ ধরে অকেজো স্লুইচগেট থাকায় পানি অপসারন বন্ধ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, উপজেলা প্রশাসন কান্তার বিলে গতবছর খননকৃত পুকুরের মাঝখান দিয়ে ক্যানেল তৈরি করলেও পর্যাপ্ত পরিমানে তা কাজে আসছে না ফলে কান্তার বিলসহ আশেপাশের প্রায় ৫০০ হেক্টর ফসলি জমিতে ইরি চাষ, বোড় চাষ এমনকি আমন চাষ করা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।

জানা গেছে, বিলটিতে অপরিকল্পিত পুকুর খনন করেছেন পুঠিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম জুম্মা, ভালুকগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাকবীর হাসান ও উপজেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি শেখ মুক্তাদির শরিফ, জিউপাড়া ইউনিয়নের বিল সমুহে স্থানায়ী মাছ চাষিরা লিজ নিয়ে পুকুর খনন করেছেন। এদিকে উপজেলার ভালুকগাছি ও জিউপাড়া এই দুটি ইউনিয়নের বিল সমুহের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা না গেলে উক্ত বিলের প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি ও বোর চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

নদী মাতৃক দেশের ঐতিহ্যবাহী নদীগুলোর মধ্যে বড়াল, মুসাখাঁ, নারদ, গদাই ও আত্রাই নদীর শাখা গুলোর মাঝেও অসংখ্য বাঁধ দেয়া রয়েছে এবং চারঘাট উপজেলায় স্লুইচ গেট দিয়ে পানি আটকে রাখায় নদীগুলো স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ব্যহত হচ্ছে। এগুলো অপসারন করে ঐতিহ্যবাহী নদীগুলোর পানি স্বাভাবিক প্রবাহ চালু করলে কৃষকরা জলাবদ্ধতার ছোবল থেকে যেমনি মুক্তি পাবে তেমনি নদীগুলোরও নাব্যতা ফিরে আসবে। পাশাপাশি কৃষকরাও দ্বিগুন ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হবে বলেও মনে করেন স্থানীয় কৃষক নেতারা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুনজুর রহমান জানান, প্রথম থেকেই আমরা অপরিকল্পিত পুকুর খনন কাজের বিপক্ষে কথা বলেছি তারপরও এটা রোধ করা যায়নি। উপজেলার প্রায় প্রতিটি বিলেই স্থানীয় প্রভাবশালীরা ধানি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করেছেন ফলে বিলে যাদের অল্প জমি রয়েছে তাদের জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে ফলে তারা সময় মত ফসল ফলাতে পারছেন না।

তিনি আরো বলেন, আমরা কয়েকবার জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েকটি স্থানে ব্যবস্থাও নিয়েছি এতে স্থায়ী সমাধান হয়নি। তবে সম্মিলিতভাবে সকলে এগিয়ে আসলে এবং সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা গ্রহন করছে তবেই এর সমাধান মিলবে বলেও মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য যে, চলতি বছরের গত ১৫ জুলাই ও ১৬ জুলাই ৭ দফা দাবিতে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি পুঠিয়া উপজেলা শাখা পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও নাটোর জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করলেও এব্যপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেও জানান তারা।