পিয়া চলছেন…

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

খুব ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর। একদিকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) উপস্থাপনা, অন্যদিকে নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ চালু হবে সামনের মাসে। গত মাসে তিনি বার কাউন্সিলের সনদপত্রও পেয়েছেন। পুরোদস্তুর কাজের মৌসুম চলছে মডেল, উপস্থাপক, আইনজীবী ও ব্যবসায়ী পিয়ার।

সাক্ষাৎকারের জন্য সময় মিলছিল না। অবশেষে ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে অধুনার কাছে ধরা দিলেন। শুরুতেই বললেন, ‘এখনো কাজ করছিলাম। আসলে সামনের মাসে আমার কো-ওয়ার্কিং স্পেসের (ভাড়া নিয়ে অনেক জন মিলে কাজের জায়গা) উদ্বোধন। চলছে বিপিএলও। ১ ফেব্রুয়ারি বিপিএলের খেলার দিন একটি পরীক্ষাও আছে আমার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এক্সিকিউটিভ এমবিএ কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা।’ একনিশ্বাসে সব বলে ফেললেন জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া।

পিয়ার কোনো কিছু নিয়েই লুকোচুরি নেই। সোজাসাপ্টা কথা, খোলামেলা পোশাক নিয়ে তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু ‘পাছে লোকে কিছু বলে’—তা আগেও পাত্তা দেননি, এখনো দেন না। কথা শুরুই হয় বিপিএলের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কেমন লাগছে? যেহেতু খেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই, হোমওয়ার্ক করতে হয় কিনা? ‘অবশ্যই হোমওয়ার্ক করতে হয়। বাংলাদেশে ক্রিকেট ভালোবাসে না, এমন লোক নেই। অন্য কিছু না দেখলেও খেলা ঠিকই সবাই দেখেন, আলোচনা করেন।’

বিপিএল ধরেই প্রশ্ন এল—আপনাকে নিয়ে ফেসবুকে নানা রকম ট্রল করা হয়েছে। অকপট উত্তর পিয়ার, ‘যখন ট্রলগুলো ভাইরাল হয়েছে, আমি তখনো ব্যাখ্যা দিয়েছি। আবার বলছি, সবাইকে নিয়ে কিন্তু কথা হয় না। ভালো কিছু করলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। বিশেষ করে মেয়েরা ক্যারিয়ারে উন্নতি করলে তাঁদের নিয়ে চারপাশে নেতিবাচক কথা শুরু হয়ে যায়।’

সাক্ষাৎকারের শেষের কথা হতে পারত, তিনি জীবনে শুধু সফল হতে জন্মেছেন। কিন্তু শুরুতেই এটি বলতে হচ্ছে। কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা তিনি উড়িয়েছেন বিশ্বাঙ্গনে। পিয়া নিজেও মনে করেন, বয়স ত্রিশ হওয়ার আগে তিনি যা যা করতে চেয়েছেন, সেগুলো সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছেন। আক্ষেপ শুধু সিনেমায় কাজ করা নিয়ে, মনে করেন, যতটা ভালো করার কথা ছিল, ততটা করতে পারেননি।

বেশি উচ্চতার ভালোমন্দ
‘মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি মডেল না হয়ে অন্য কিছু হলে আরও বেশি ভালো করতাম। কিন্তু সবচেয়ে কাছের মানুষ আমার স্বামী ফারুক হাসান প্রায়ই বলেন, “তুমি মডেলিং বেছে নাওনি। মডেলিং তোমাকে বেছে নিয়েছে।” এমনি এমনি অবশ্য তিনি এ কথা বলেননি। যুক্তি দিয়ে আমাকে বুঝিয়েছেন। উচ্চতা, ছিপছিপে শারীরিক গঠন, মসৃণ ত্বক, দিঘল কালো চুল—একজন মডেলের যা সবচেয়ে প্রয়োজন, সবই আমার আছে। আর বাংলাদেশে এমন দীর্ঘ উচ্চতার মেয়ের দেখা তো সচরাচর মেলে না। এই উচ্চতাই আমাকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ঢাকায় আসতে বাধ্য করেছিল। আমার জন্য শাপেবর হয়েছিল।’ বললেন পিয়া।

যদিও উচ্চতার জন্য অনেক ব্যঙ্গ সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। খুলনায় সে সময় এত লম্বা মেয়ে ছিল না। নেতিবাচক কথায় মন ভেঙে যাওয়ায় তাঁর মা এসএসসি পরীক্ষার পর ২০০০ সালে পিয়াকে ঢাকায় রেখে যান। পরিবারের অন্যরা ‘উচ্ছন্নে যাওয়া’ মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন না। মা-ই একমাত্র পিয়াকে সমর্থন করেছিলেন। পিয়া বলেন, ‘কেউ কি বিশ্বাস করবে আমি মডেল হওয়ার জন্য ঢাকায় আসিনি, এসেছিলাম নেতিবাচকতা থেকে বাঁচতে। খুলনায় আমি বাঁচতে পারতাম না। সবার বাঁকা কথা শুনে মাঝেমধ্যে মনে হতো মরে যাই। অত অল্প বয়সে এমন আচরণ কী যে কষ্ট দিত আমাকে!’

মিস বাংলাদেশ থেকে শুরু
আলোকচিত্রী অপূর্ব আবদুল লতিফের পরামর্শে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই তিনি মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠিয়েছিলেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ‘মিস বাংলাদেশ ২০০৭’ হয়েছিলেন পিয়া। সেই শুরু হলো। কলেজে পড়ার সময়ই আড়ংসহ বড় বড় সব হাউস ও ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করে ফেললেন। কলেজ শেষ হলো। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত হয়েছেনও। ঢাকার লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ থেকে আইনে পড়াশোনা শেষ করেছেন। পিয়া বলেন, ‘আমি জানতাম, ব্যারিস্টারি পড়তে হলে অনেক টাকা লাগবে। তাই কাজ করে যা সম্মানী পেতাম, জমিয়ে রাখতাম। যা-ই হোক, ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়ার্ল্ড মিস ইউনিভার্সিটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। এটা আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।’

নতুন অভিজ্ঞতা
কোরিয়ায় গিয়ে নতুন এসব পেশাগত শব্দের সঙ্গে পরিচয় হলো পিয়ার। কথা হলো, ইতালির একটি নামকরা মডেল এজেন্সি জে এজেন্সির সঙ্গে। তাদের এজেন্সির মডেল হওয়ার প্রস্তাব পান তিনি।
নতুন এক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন তিনি। ‘সেখানে আমাকে প্রথম দিন বলা হলো, আমার শরীরের মাপ দিতে হবে। আমি মাপ দিতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওরা বলল, পোশাক খুলে মাপ দিতে। ভড়কে গেলাম। ধাতস্থ হতে সময় লেগেছিল। তবে এই প্রতিযোগিতায় বিকিনি পরা আবশ্যিক ছিল না। কেউ চাইলে পরতে পারবে। আমার অস্বস্তি লেগেছিল, তাই আমি পরিনি। ভেবেছিলাম হয়তো এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। কিন্তু যখন ওপরের অন্তর্বাসও খুলতে বলল, আমি বলেছিলাম, এটা না করলে কি কোনো সমস্যা হবে? বাংলাদেশে তো এসব পরেই মাপ দিই। ওরা বিরক্ত হয়েছিল। পোশাকের মাপ যেন ঠিকঠাক থাকে, সে কারণে তাদের কথামতো মাপ দিতে হলো। অদ্ভুত ব্যাপার, এই বিষয়টি ওদের কাছে এতই সহজ আর স্বাভাবিক যে মনে হলো কোনো যন্ত্রের মাপ নিচ্ছে যেন। আমার শরীরের দিকে অন্য কোনো দৃষ্টিতে একবারও তাকায়নি। পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো একেই বলে।’

সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলা
স্পেনে মাদ্রিদ কালচারাল ফেস্টিভ্যালে কাজ করেছেন। ২০১৩ সালে ইন্ডানিয়ানা প্রিন্সেস মুম্বাইতে সেরা সুন্দরীর মুকুট ওঠে তাঁর মাথায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৭ জন প্রতিযোগী অংশ নেন। এখানেও অনেক গল্প আছে তাঁর। প্রথম বিকিনি পরতে বলা হয়। তিনি কর্তৃপক্ষকে জানালেন, বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে বিকিনি পরলে সমস্যা। এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে তাঁরা খেপে গেলেন। বললেন, এটা প্রতিযোগিতার অংশ। আর এটা শর্তের মধ্যে ছিল। পিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, বিকিনি পরবেন। ভাবলেন, কোনো অন্যায় করছেন না। অন্য দেশের সবাই তো পরছে। আমি এখানে থাকা মানে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। রাজি হয়ে গেলেন।

এই প্রতিযোগিতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। দৃঢ় মানসিকতার মানুষ পিয়া বলেন, ‘আমার শরীর নিয়ে বা শারীরিক গড়ন নিয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী। কোনো পোশাকে কোনো অস্বস্তি হয় না।’

বিশ্বখ্যাত ভোগ সাময়িকীর (ভারত সংস্করণ) প্রচ্ছদের মডেল হয়েছেন। ২০১৮ সালে স্পেনে আরেকটি বিকিনি ফটোশুট করে আসেন।

পিয়া বলেন, ‘পরিবারে শান্তি ও সমর্থন থাকলে নির্বিঘ্নে কাজ করা যায়। বিয়ের পর স্বামী খুব সমর্থন দেন আমাকে। তাই শুধু এগিয়ে চলছি…।’