পাহাড়ে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল, ৬ মাসে ২৪ খুন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ের রাজনীতিটা একটু অন্যরকম। ভৌগোলিক কারণে এ অঞ্চলের প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু যেমন আলাদা, তেমনি স্বার্থের ধরনেও ভিন্ন। আর এই ভিন্নতার কারণে ক্ষমতার বলয়গুলোও কিছুটা ভিন্ন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন মূলত স্থানীয় চারটি শক্তিশালী গ্রুপের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পাহাড়ের রাজনীতি। আধিপত্য বিস্তার ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন সময় একটি দলের ভাঙনের মাধ্যমেই এই চারটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব কারণেই বিভিন্ন সময় অশান্ত হয়ে উঠছে পাহাড়। সময়ে অসময়ে রক্ত ঝড়েছে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে লাশের মিছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়ি অঞ্চলের স্থানীয় গ্রুপগুলো।

১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশক পার হলেও সমাধান হয়নি পাহাড়ের সমস্যাগুলোর। সম্প্রতি আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। গত ৬ মাসে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক),জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপের ২৪ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন তিন পার্বত্য জেলায়।

জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ অঞ্চলে অস্থিরতা বিরাজ করলেও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার মাধ্যমে অস্ত্রসমর্পণ করে পাহাড়ের তৎকালীন একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারকারী আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এরপর সন্তু লারমার নেতৃত্বে এক বছরও ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি জেএসএস। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসীত খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে আরেকটি সংগঠন। শুরু হয় দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের লড়াই। ২০০৭ সাল পর্যন্ত মূলত জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ- এই দুটি দলই স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে। তবে ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতির মধ্য থেকেই সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং সংগঠনটির একটি অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

এরপর ২০১০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস এমএন-লারমা) নামে নতুন দল গঠন করেন তারা। ২০১৭ সালে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের একটি অংশ তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পৃথক আরেকটি দল গঠন করে। এসব দলভাঙা আর দল গড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে অপহরণ-রাজনীতি ঢুকে পড়ে পাহাড়ে। মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়েছে, আবার প্রতিপক্ষের গ্রপের সদস্যদেরও অপহরণ করা হয়েছে অনেকবার। সম্প্রতি হামলা, নিখোঁজের ঘটনা, খুন ও পাল্টা খুনে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে, এই ৬ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৪ ব্যক্তি খুন হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ থাকলেও গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তা আবার শুরু হয়। এতে করে আবারও উদ্বেগ বেড়েছে পাহাড়ে।

গত ৩ ও ৪ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা)-এর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শক্তিমান চাকমা এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৬ জন খুন হয়েছেন। সর্বশেষ গত ২১ মে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় উজ্জল কান্তি চাকমা নামে ইউপিডিএফ-এর এক সাবেক সদস্য খুন এবং পরের দিন ২২ মে খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় দিনেদুপুরে দুই পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এরই মধ্যে সোমবার (২৮ মে) সকালে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলার সাজেক থানাধীন করল্যাছড়ি গ্রামে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) তিন  কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পেছনের মূল কারণ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আধিপত্য বিস্তার। ইউপিডিএফ-এর সামরিক শাখার সাবেক কমান্ডার তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নতুন দল ( ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) গঠনের পর থেকে ইউপিডিএফ-এর ১১ নেতাকর্মী খুন হয় এবং চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন এলাকার আধিপত্য কমতে থাকে গ্রুপটির। কিন্তু আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসন ছিনিয়ে নিতে অনেক আগে থেকে মরিয়া ইউপিডিএফ। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক শত্রু জেএসএস-এর সঙ্গে সখ্যতা বৃদ্ধি করে ইউপিডিএফ।

এসব ব্যাপারে জেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের রাজনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক বিভুরঞ্জন চাকমা বলেন, ইউপিডিএফ পাহাড়ের শান্তি চায় না। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পাহাড়ে শান্তি ফেরার কথা। কিন্তু তাদের বিরোধিতার কারণে শান্তির পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বলয় থেকে বের হয়ে যে বা যারা প্রতিবাদ কিংবা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তাদের তারা হত্যা কিংবা গুম করছে। যার প্রমাণ তপন জ্যোতি চাকমাসহ অন্যান্যদের খুন হওয়ার ঘটনা।’ পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউপিডিএফ-কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পাহাড়ি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধে জেএসএস-এর সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি আংশিক সত্য জানিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থিত গণতান্ত্রিক যুবফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিরোধিতা করেনি। চুক্তির কিছু ধারার বিরোধিতা করে আসছে। বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করে চুক্তির বাস্তবায়ন করতে হবে।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইউপিডিএফ-এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে দাবি করে তিনি আরও বলেন,‘নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হলেও সংসদে যেতে দেওয়া হয়নি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইউপিডিএফ যেকোনও সমঝোতা করতে পারে।’

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা একসময় ইউপিডিএফ-এর সঙ্গে থাকলেও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের অপরাধে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জেএসএস-এমএন লারমা গ্রুপের সমর্থনের ছত্রছায়ায় তিনিসহ ইউপিডিএফ থেকে বিভিন্ন সময় বহিষ্কৃতরা মিলে নতুন সংগঠন করেছে। কিন্তু পাহাড়ি জনগণ সেটিকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নয় বরং নব্য মুখোশ বাহিনী হিসেবে তাদের চেনে।’ বর্মাসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী না করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান বলেন, ‘ সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’ অপরাধীদের ধরতে পুলিশসহ যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি।

 

বাংলা ট্রিবিউন