পাহাড়তলীর বিহারি পল্লীজুড়ে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

কাপড়ের ওপর ছোট ছোট পুঁতির নকশা। এতটাই নিখুঁত, দেখে মনে হবে যন্ত্রে বোনা। যদিও তা হাতে বোনা। হাতে নকশা এঁকে তার ওপর সুই-সুতা দিয়ে বসানো জরি-চুমকি-পুঁতি। সুই-সুতার ফোঁড়নেই ফুটে উঠছে কারচুপি ও জারদৌসির কাজ। চট্টগ্রামের ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ঝাউতলা ও ওয়্যারলেস এলাকার বিহারি পল্লীর ঘরে ঘরে এখন এ চিত্র দেখা যাবে। ঈদ সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের কাজে ব্যস্ত এখানকার জারদৌসি ও কারচুপির কারিগররা।

বিহারি পল্লীর কারিগরদের সূক্ষ্ম হাতের কারচুপি ও জারদৌসির কাজ চট্টগ্রামে বেশ জনপ্রিয়। নগরীর অভিজাত শপিংমলগুলোতেও এখান থেকে সরবরাহ করা কাপড়ের বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে। তবে ভারতীয় পোশাকের বাজার দখলসহ নানা কারণে এখানকার কারিগরদের কাজের ক্ষেত্র এখন অনেকটাই সংকুচিত। সারা বছর কাজ না থাকায় আয়ের ভিন্ন উৎসও তৈরি করে নিয়েছে এখানকার অনেক পরিবার। কিন্তু আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে এখনকার চিত্র পুরোপুরি আলাদা। ঈদ উৎসব সামনে রেখে ঠিকই কাজের ব্যস্ততায় জমজমাট এখন পল্লীটি।

ওয়্যারলেস ৮ নং রোডের বিহারি পল্লীর চয়েস কারচুপি হাউজের কারিগর মো. রাশেদ হোসেন এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ২২ বছর ধরে। তিনি বলেন, আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন আরো জমজমাট ব্যবসা হতো। সারা বছর কাজ লেগেই থাকত। তিনি বলেন, যেকোনো ডিজাইনের ছবি এনে দেখালে আমরা হুবহু সে কাজ করে দিতে পারি। তবে শাড়িতে খুব ভালো কাজ করা যায়। আমরা শাড়িতে ৮০ হাজার টাকার কাজও করেছি। এ ধরনের কাজ করতে সময় লাগে মাসখানেক। তবে সেগুলো করা হয় খুব কম সংখ্যায়। ঈদ এলেই কাজের চাপ অনেক বেড়ে যায়। এখন আমাদের নতুন কোনো অর্ডার নেয়ার সুযোগ নেই।

স্থানীয়রা জানান, এখানে আগে বড় বড় দোকানে একসঙ্গে বড় পরিসরে কাজ হতো। এখন গড়ে উঠেছে ছোট ছোট দোকান। ১০ বছর আগেও এখানকার দুই শতাধিক বাড়িতে বছরজুড়েই কারচুপির কাজ চলত। এখান থেকে কাজ শিখে যাওয়া কারিগরদের অনেকেই এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন।

ঝাউতলা স্টেশন রোড এলাকার পাপ্পু বুটিকস হাউজের মালিক মো. খালিদ জাফর বলেন, ঈদের কাজ অনেক। যেহেতু ঈদের আর বেশি দিন বাকি নেই, সেজন্য ডেলিভারি দেয়ার জন্য আমাদের সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। ঈদের আগেই আমাদের এ কাজগুলো গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিতে হবে। ঈদের কাজের চাপ সামলাতে আরো পাঁচজন বাড়তি লোক নিয়োগ দিয়েছি। ঈদের ব্যস্ততায় জারদৌসি-কারচুপির কারিগররা কিছুটা আশার মুখ দেখলেও, সারা বছর কাজের পরিমাণ ঈদের সময়ের মতো থাকে না। এজন্য এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।

বিহারি পল্লীতে সরেজমিন দেখা যায়, সালোয়ারের নকশা অনুযায়ী কারচুপির কাজ হচ্ছে ২-২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া নকশা অনুযায়ী পাঞ্জাবিতে ৮০০ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকায়, প্রতিটি থ্রি-পিসে দেড়-দুই হাজার, লেহেঙ্গায় ৫-১৫ হাজার, বোরখায় ৩-৬ হাজার, ওড়নায় দেড়-দুই হাজার, শাড়িতে ১০-৪০ হাজার টাকায় কারচুপি ও জারদৌসের কাজ করা হয়। তবে খুব ভালো ও সূক্ষ্ম ডিজাইনের জন্য শাড়িতে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত কাজ করা হয় বলে কারিগররা জানান। ঈদ ঘিরে দুই মাস আগ থেকেই এখানকার বুটিক হাউজগুলোয় ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। বর্তমানে ঈদের অর্ডারের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

কারিগররা জানান, ভালো ডিজাইনের একটি লেহেঙ্গা ও বোরখা ডিজাইন করতে সময় লাগে কমপক্ষে তিনদিন। থ্রি-পিস একদিনেই হয়ে যায়।

বিহারি পল্লীর ‘চয়েস কারচুপি হাউজের’ স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জালাল বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কারচুপির কাজেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। কাজের মানও আরো উন্নত হয়েছে। ভারতের কাজের সঙ্গে তুলনা আমরা না করতে চাইলেও, তারা অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারচুপির কাজ করে। সেখানে আমরা এখনো খালি হাতের সাহায্যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি। আমাদের নকশায় নতুনত্ব থাকলেও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। পূর্বপুরুষের হাত ধরে তাদের কাজ দেখেই আমরা কাজ শিখেছি, যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিখে নিচ্ছে আমাদের কাছ থেকে।

চট্টগ্রামের পোশাক ডিজাইনার উম্মে হাবিবা তন্বি জানান, বিহারি পল্লীর কারচুপির কাজ গুণে ও মানে বেশ ভালো। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় তাদের কাজের চাহিদা আছে। তবে ভারত থেকে আসা কাপড়ের ওপর পুঁতির কাজগুলো যান্ত্রিকভাবে করা থাকে। দেশী শিল্পগুলো এ জায়গায় বিদেশী কাপড়ের কাছে মার খেয়ে যায়। এজন্য বিহারি পল্লীতে যারা কাজ করছেন, তাদের কাজে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলেই শিল্পটি আরো দীর্ঘদিন টিকে থাকবে।

বাজারে বিদেশী কাপড়ের উপস্থিতি, ক্রেতাদের চাহিদায় ক্রমাগত পরিবর্তন, ভালো মানের কারিগরের সংকট সত্ত্বেও পাহাড়তলীর কারচুপির কারিগররা শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। এক্ষেত্রে সরকার বা চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে বিশেষ প্রণোদনাসহ সহায়তা পেলে এ শিল্প টিকে থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।