পানির দামে মা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়তে মা ইলিশ ছুটে আসে পদ্মায়। তাই ইলিশ ধরা ৭-২৮ অক্টোবর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে সরকার। যাতে করে মা ইলিশগুলো নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে পারে।

তবে নিষিদ্ধ মৌসুমেও থেমে নেই শিবচরের চারজানাত বন্দরখোলা ও কাঁঠালবাড়ী এলাকার পদ্মায় ইলিশ শিকার। দেদারছে ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা। পদ্মার চরাঞ্চলের দুর্গমচর এলাকাসংলগ্ন পদ্মায় অনেকটা গোপনেই জেলেরা ব্যস্ত থাকেন ইলিশ শিকারে।

এ ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই উদ্ধারকৃত মা ইলিশ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তাদের বাসার ফ্রিজ ভর্তি মাছ রয়েছে বলে এলাকাবাসী ও জেলেরা জানান। কারণ উদ্ধারকৃত মাছ এ পর্যন্ত অল্পসংখ্যক বিতরণ করা হয়েছে এতিমখানা বা লিল্লাহ বোডিংয়ে।

স্বাভাবিক সময়ে যে ইলিশের বাজারমূল্য কেজিতেএক হাজার টাকা, সেই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দেড়শ টাকায়! এত সস্তায় ইলিশ পেয়ে স্থানীয় দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি ভিড় করছেন পদ্মার পাড়ে। তারা ব্যাগ বোঝাই করে ইলিশ নিয়ে ফিরছেন বাড়িতে!

শিবচর উপজেলা মৎস্য অফিসসূত্র জানায়, ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৩৯ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পাঁচজনকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ৮০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ও ৪০০ কেজি মা ইলিশ জব্দ করা হয়েছে।

জব্দকৃত মাছ ৮টি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া গত শনিবার ১৬ জেলেকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও পাঁচজনের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে মোট পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ মৌসুমে ইলিশ শিকার বন্ধে অভিযান চালানো হয় পদ্মায়। তবে দুর্গম অঞ্চল প্রায় সময়ই অভিযানের বাইরে থেকে যায়। জেলেরা কৌশলে গভীর রাতে ও খুব ভোরে পদ্মার বিভিন্ন এলাকায় মাছ শিকার করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে ইলিশের জাল নদীতে ফেলে কৌশলে জালটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানিতে লুকিয়ে রেখে মাছ শিকার করেন বলেও জানা গেছে।

উপজেলার চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী ও বন্দরখোলা এলাকার চরসংলগ্ন পদ্মা নদীতে জেলেরা ইলিশ শিকার করে থাকেন। চরাঞ্চলের এই পদ্মার পাড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুচরা বিক্রি হয় এ ইলিশ।

সরেজমিন চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী ও বন্দরখোলা ইউনিয়নের ইলিশ বিক্রির চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, অভিযান শুরু থেকেই প্রায় দিনই ভোর থেকেই ব্যাগ হাতে পদ্মার পাড়ে নারী-পুরুষের ভিড়। রয়েছে ছোট ছেলেমেয়েরাও। উদ্দেশ্য- সস্তায় ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরবে।

ইলিশ কিনতে আসা আসলাম জানান, তিনি প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা থেকে এসেছেন। এই সময় পদ্মার পাড়ে সস্তায় ইলিশ পাওয়া যায়, এ খবরে তিনি মাছ কিনতে এসেছেন। তার দিনমজুর বাবার পক্ষে অন্যান্য সময়ে দাম দিয়ে ইলিশ কেনা সম্ভব হয় না। তাই সস্তায় একটু বড় ইলিশ কিনতে কষ্ট করে এই দুর্গম চরে এসেছেন।

জেলেদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, পদ্মায় মাছ শিকারকারি জেলেরা বেশিরভাগই দরিদ্র। ঋণ করে জাল ও নৌকা কিনে পদ্মায় মাছ ধরেন তারা। ফলে মাসে মাসে ঋণ পরিশোধের কিস্তি দিতেই হচ্ছে।

তা ছাড়া সংসারের খরচ তো আর থেমে নেই। তাই মাছ শিকার বন্ধ করা আর হয়ে উঠে না। মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় জেলেদের সরকারিভাবে সাহায্য দেয়ার কথা, কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সাহায্য আমরা পাইনি।

চরজানাজাত এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, আমি প্রথম দিকে এ সময় মাছ ধরতে যেতাম না। গত বছরও ধরিনি। কিন্তু অন্যরা তো ঠিকই ধরছে। তারা মাছ বিক্রি করে পয়সা কামাচ্ছে। তাই এবার আমিও মাছ ধরতে নেমেছি। তবে দিনে একবারই পদ্মায় জাল ফেলি।

তিনি আরও বলেন, এ সময় অনেক ‘সতর্ক থাকতে হয়। পুলিশের হাতে অনেকে ধরা পড়লে হয়রানি পোহাতে হয়। পুলিশ মাছ ও জাল রেখে দেয়।

শিবচর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এটিএম শামসুজ্জামান (দায়িত্বপ্রাপ্ত) বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি পদ্মা নদীর মাদারীপুর অংশে। দিনের পুরোটা সময়ই আমরা পদ্মায় নজর রাখছি।

তা ছাড়া জেলেদের মাছ ধরা বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যারা মাছ কিনতে আসছেন, তাদেরও সচেতন করতে চেষ্টা করছি। তার পরও সাধারণ মানুষের ভিড় পদ্মার পাড়ে লেগে থাকে।

তিনি আরও বলেন, মাছ ধরা বন্ধের প্রথম দিন থেকেই আমরা অভিযান চালিয়ে আসছি। জেলেদের আটক, মাছ জব্দ ও জাল ধ্বংস কার্যক্রম চলছে। তবে কতসংখ্যক জেলেকে এ পর্যন্ত আটক করে জেলা জরিমানা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা।

শিবচর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা এটিএম শামসুজ্জামান জানান, মাছ ধরা এখনও নিষেধ। নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করার অভিযান চালাতে গিয়ে আমরা চরজানাজাত খাসেরহাট এলাকায় লাঞ্ছিত হয়েছি। কিন্তু জেলেরা তো থেমে নেই। থেমে নেই মাছ ধরা ও বিক্রি। আর শত শত মানুষ কম দামে পেয়ে কিনছেও। মাছ না ধরা ও বিক্রি কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।

শিবচর থানার ওসি জাকির হোসেন মোল্লা জানান, জেলা ও উপজেলা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তা মাঝেমধ্যেই নদীতে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার জন্য নদীতে অভিযানে নামেন। তাদের চাহিদামতো আমরা পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করি। পুলিশের কোনো লোক জব্দকৃত মাছ নেয় না বলে তিনি দাবি করেন।

মাদারীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার জানান, গত কয়েক দিন ধরেই আমরা নদীতে অভিযান পরিচালনা করে আসছি। কিন্ত অভিযানকালে জালে জড়িত জীবিত মাছ আমি পানিতে ছেড়ে দিই।

জেলেদের আটক করা হচ্ছে। গত শনিবার সকাল থেকে ৫৪ জেলেকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে বলে জানান ওই মৎস্য কর্মকর্তা। যুগান্তর