পাকিস্তানকে ‘দখল’ করতে পারে চিন, ভারত কি তাকিয়ে দেখবে কেবল

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

পাকিস্তানের পলিটিক্যাল ইকনমিস্ট এস আকবর জিয়াদি সম্প্রতি ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর সৌজন্যে একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি চিন-পাক ইকনমিক করিডর নিয়ে বিস্তর অভিযোগ তোলেন।

তাঁর মতে, বেজিংয়ের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। জিয়াদি তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম রেখেছিলেন— ‘চিন কি পাকিস্তানকে দখল করেছে’ এবং  এই শিরোনামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই তিনি তাঁর বক্তব্যকে বিস্তার করেন।

কার্যত চিন-পাক অর্থনৈতিক করিডর বিষয়টি অনেক বেশি পরিমাণে সার্বভৌমিকতার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। এই কারণেই ভারত চিন-পাক ইকনমিক করিডর-এর বিরোধিতা করে ও সেই সঙ্গে মে মাসে বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ সম্মেলনে যোগদান এড়িয়ে যায়।

কারণ হিসেবে ভারত এই প্রকল্পে স্বচ্ছতার অভাব থেকে শুরু করে প্রকল্পের বিপুল খরচ, সেই সঙ্গে চিন-পাক ইকনমিক করিডরে নজরদারি ও সেখানে চিনের শ্রমশক্তি নিয়োগের মতো বিষয়কে তুলে ধরে।

ওবোর সম্মেলন, ছবি: এএফপি

জিয়াদি শ্রীলঙ্কা, তাজিখস্তান, এবং বেশ কিছু আফ্রিকান দেশের উদাহরণ তুলে এনে দেখান যে সেই দেশগুলিতে চিনের বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত ভাল ফল দেয়নি। এই সব দেশে অদেয় ঋণের বিনিময়ে চিনা কোম্পানিগুলির হাতে জমি তুলে দেওয়া হয়।

যদি ফান্ড প্রদানের বিনিময়ে দেশের উপরে চিনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিত ভাবেই ভারত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ওবোর-এ যোগ দিতে পারে না।

জিয়াদি বাংলাদেশের উদাহরণ তুলে এনে দেখান যে, বেজিংয়ের সঙ্গে দর কষাকষিতে সেই দেশ বেশ সফল। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পরিবেশ সংক্রান্ত ইস্যুকে সামনে রেখে চিনের প্রকল্পগুলিকে দেখে। এতে একথা প্রমাণিত হয় যে চিনের ওবোর-কাহিনিকে চ্যালেঞ্জ জানানোই যায় এবং এর গোপন পকেটে লুকনো অভিসন্ধিগুলোকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসাও যায়।

কিন্তু সম্মেলন এড়িয়ে সেই কাজ করা সম্ভব নয়, কারণ সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের মতো ভারিক্কি শক্তি উপস্থিত ছিল। সেখানে ভারতের অনুপস্থিতি যে সেই সব দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট দেশের বিদেশ মন্ত্রকের পদাধিকারীরা জানিয়েছেন। এই সম্মেলনে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিনিয়র অ্যাডভাইসার ম্যাট পটিংগার। আর জাপানের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের লিবেরাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মুখ্য সচিব তোশিহিরো নিকাই। ভুটান ছাড়া ভারতের সব প্রতিবেশীই সেখানে হাজির ছিল।

জিয়াদির মতে, সার্বভৌমিকতার বিষয়ে প্রতিবাদকে সামনে রেখে সেখানে ভারতের যোগ দেওয়া উচিত ছিল। প্রস্তাবিত করিডর যেখানে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে যাচ্ছে, যে অঞ্চলকে ভারতও নিজের বলে দাবি করে, সেই জায়গাটাকে সামনে এনে সম্মেলনে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। সেই সঙ্গে উচিত ছিল ওবোর-এর সঙ্গে জড়িত চিনের পক্ষে অস্বস্তিকর বিষয়গুলিকে তুলে ধরা এবং স্বচ্ছতার বিষয়ে বেজিংকে বাধ্য করা।

চিনও ভারতের যোগদানের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। ওবোর প্রকল্পে ভারতকে অঙ্গীভূত করতে পারলে চিনেরই লাভ। কিন্তু অন্য দিক থেকে দেখলে ভারত সুযোগ হারিয়েছে। সুযোগ হারিয়েছে ওবোর-সংক্রান্ত অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোকে সমক্ষে আনার বিষয়ে, সুযোগ হারিয়েছে একটা মুক্ত ফোরামে চিনের ভারসাম্যকে ঘেঁটে দেওয়ার ব্যাপারেও।

জিয়াদি জানান, অনেকেই একথা বলেছেন যে, চিন পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারে, ভারত আমেরিকাকে যদি সেই প্রেক্ষিতে ঘাঁটি তৈরির সুযোগ দেয়, তা ভারতের পক্ষে আত্মহননের সামিল হবে।

আমেরিকার সঙ্গে ভারতের লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট ইতিমধ্যেই হয়েছে, যার দ্বারা দুই পক্ষ পরস্পরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারে সম্মত হয়েছে। খুব খারাপ হলে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সেনা মোতায়েনও করতে পারে, এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। পেন্টাগন পাকিস্তানে চিনের বেস তৈরির ব্যাপারে এমন সব তথ্য দিচ্ছে যে, তাতে ভারতে মার্কিন সমর-ঘাঁটি বানানোর কাজটা ন্যায্য বলে মনে হতে পারে।

যদি ভারত তার স্বাধীনতার ব্যাপারে গর্বিত হয়ে থাকে, তবে সে তার কৌশলগত স্বাধীনতার কথাও ভাববে, সেই সঙ্গে বৈদেশিক শক্তি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে পদক্ষেপ করার ব্যাপারটাও মাথায় রাখবে। পাকিস্তানকে ও সেই সঙ্গে পকিস্তানের জন্মসূত্র দ্বিজাতি তত্ত্বকে আটকাতে গলে ভারতকে এক সর্বময় জাতীয়তাবাদের দিকে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে, যা অনেকটাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মডেল। কিন্তু তার বদলে দেশের ও সমাজের যে নিরন্তর গেরুয়াকরণ এদেশে চলছে, তা বিপদ ছাড়া অন্য কিছুই ডেকে আনবে না।

তাঁর বক্তৃতায় জিয়াদি এ কথাও বলেন, এর আগে পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত গা ঘষাঘষি করেছে, তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সৌদিকে নাক গলাতে দিয়েছে। সুতরাং আজ যদি চিন তাকে ‘নরম মাটি’ বলে ধরে নেয়, তবে কি ভুল করবে?

অন্যদিকে চিনের সঙ্গে টক্কর দিতে হলে ভারতের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়ানো দরকার। ভারতের গণতন্ত্র, মিশ্র অর্থনীতি, ব্যবস্থাগত নমনীয়তা চিনের নেই। সেখানে চিন তার একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যে এক চরম গণতন্ত্রকে সম্ভব করে তুলতে চাইছে।

ওবোর-কে যত জাঁকজমক সহকারে পেশ করাই হোক না কেন, এটা চিনের নিজের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টাও হতে পারে। এটা মাওয়ের কালচারাল রেভল্যুশনের মতো ব্যর্থ হতেই পারে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার কোনও কোনও দেশের কাছে চিন-সঙ্গের অভিজ্ঞতা ভাল নয়, সেটা মনে রাখা দরকার। সূত্র: এবেলা