পাইলট, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুপারহিউম্যান!

আবদুল্লাহ আল মারুফ:


ক্রিকেট, বিশ্বকাপ, বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি! এই চারে যেন মিলে মিশে একাকার! ক্রিকেটই যেন আজ এই জাতির অন্যতম বড় আনন্দ উপলক্ষ্য! আর ক্রিকেট বিশ্বকাপ হলেতো কোন কথাই নেই!! পাড়া-গলির অতি সাধারণ ক্রিকেটই যেই জাতিকে প্রতি ক্ষণেক্ষণে রোমাঞ্চের আবহ এনে দেয়, আবেগে ভাসায় বা পরাজয়ে অশ্রুসিক্ত করে, সে জাতিকে বিশ্বকাপ কি উপহার দেয় প্রতি ক্ষণে ক্ষণে, কল্পনা করুন তো! ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫ বা ২০১৯! কত আবেগ, কত প্রার্থনা, আর কত অনন্দ বেদনায় অশ্রুসিক্ত হবার গল্পে মোড়ানো! বাবা মার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে গভীর রাতে মিছিলে মিছিলে দেশের রাজপথ কাঁপানো, আনন্দে প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরা, আম্পায়ার এর অসদাচরণে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা নতুবা তীরে এসে তরী ডুবানোর কষ্টে নিরবে নিভৃতে ডুকরে কাঁদা! এমন কত শত গল্পে মোড়ানো এই দেশের ক্রিকেট আর ক্রিকেট বিশ্বকাপ!

একটি বার ভাবুন তো, বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে! কিন্তু বিশ্বকাপ না! সারাটি বছর ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি খেলবে কিন্তু বিশ্বকাপ আসলেই আপনি আপনার প্রিয় মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকদের দেখতে পাবেন না! পারবেন এমন একটা চিত্র কল্পনা করতে? পারবেন এইটা কত টা কষ্টের, তা উপলব্ধি করতে? পারবেন না! কিন্তু যারা ১৯৯৭ এর আগের তারা জানে এ জ্বালাটার তীব্রতা কতটুকু! কতটা কষ্ট বুকের ভেতর বাসা বাঁধতো একটা করে বাছাই পর্ব শেষ হলে! বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খুব কাছে গিয়েও বারবার ফিরে আসাটা বাঙ্গালির জন্য ছিলো ভীষন কষ্ট ও আক্ষেপের করুন অধ্যায়টির নাম!

বাঙ্গালির চিরায়ত এই আক্ষেপ ঘুঁচাতে কিছু সুপারম্যানের জন্য অপেক্ষা ছিলো বছরের পর বছর। সুপারম্যানরা আসবে, অসাধারণ সব ইনিংস খেলে প্রিয় মাতৃভূমি কে নিয়ে যাবে বিশ্বকাপে, এ প্রত্যাশায় কত বিনিদ্র রাত কেটেছে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালির তা ভাবলেও যেন আজো চোখ ছলছল করে উঠে কারো কারো!

অবশেষে বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালে আসলো এক দল সুপারম্যান। আর বাংলাদেশকে নিয়ে গেলো স্বপ্নের বিশ্বকাপে! আর সেই দলের অন্যতম একজন খালেদ মাসুদ পাইলট। যে ম্যাচ টি হারলেই স্বপ্ন থমকে যাবে আরো চারটি বছরের জন্য, সে ম্যাচেই অসাধরণ এক ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হন রাজশাহীর এই ক্রিকেটার। ৭০ রানের সে ইনিংসটিকেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও দামী ইনিংস বলা হয়! বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে যে ইনিংস লেখা থাকবে সোনার হরফে! ঐ ইনিংসে ভর করেই যে মাত্র ৭২ রানে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল, বহু আরাধ্য, বিশ্বকাপের টিকিট! ঐ ইনিংসে ভর করেই যে পুরো দেশ প্রথম ভেসেছিলো উচ্ছ্বাসে, হয়েছিলো আনন্দে আত্মহারা, কেউবা অশ্রুসিক্ত!

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সফলতম এই ক্রিকেটার ১৯৭৬ সালের ৮ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে জন্ম গ্রহন করেন। সবার কাছে পাইলট নামেই বেশি পরিচিত, ডানহাতি এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান! পাইলট নামটি শুনে অবশ্য সবাই একটু অবাক হয়ে অন্য কোন পেশার কথা ভেবে বসে! কারো কারো চোখে বিমান এর ছবিও ভেসে ওঠে! তাই অনেকেই এই নাম টির পেছোনের গল্প শুনতে মুখিয়ে থাকেন! সত্যিই পাইলট নামটির পেছনে ছোট একটি গল্প আছে। পাইলটের মামা আসলে নামটি দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় পাইলট এর মেধায় মুগ্ধ মামা চেয়েছিলেন ভাগ্নেকে পাইলট বানাতে! তাই সবসময়ই পাইলট পাইলট বলে ডাকা! আর এভাবেই বাবা মায়ের প্রিয় খালেদ মাসুদ এর নামের শেষে পাইলট নামটি যুক্ত হয়ে যায়! মামার আদরের পাইলট কালের পরিক্রমায় বিমানের হাল ধরতে না পারলেও ধরেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হাল।

প্রায় এক যুগ ধরে টেস্ট, ওয়ানডে উভয় ক্ষেত্রেই সফলতার সঙ্গে খেলেছেন! ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে পাইলটের ও অভিষেক হয় টেস্ট ক্রিকেটে। এর আগে অবশ্য ১৯৯৫ সালের ৫ এপ্রিল ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় তাঁর। ২০০৭ সালের ২৮ শে জুন শ্রীলংকার বিপক্ষে শেষ টেস্ট এবং ২০০৬ সাল এর ৫ ই ডিসেম্বর জিম্বাবুয়ে দলের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন পাইলট। ক্যারিয়ারে ৪৪টি টেস্টে ১টি সেঞ্চুরি ও ৩টি হাফ সেঞ্চুরিতে ১৪০৯ রান করেন পাইলট।

যেখানে ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে মহাকাব্যিক অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংসটি সেরা। ১২৬টি ওয়ানডে তে ৭ হাফ সেঞ্চুরিতে ১৮১৮ রান করেন রাজশাহীর এই কৃতি ক্রিকেটার! ২০০৫ সালে অষ্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলা তাঁর অপরাজিত ৭১ রানের ইনিংসটি তাঁর সর্বোচ্চ ওয়ানডে স্কোর। প্রথম শ্রেণী ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও সমান তালে ছুটেছেন পাইলট! ১১৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে পাইলটের সংগ্রহ ৩ শতক ও ২২ অর্ধশতকে ৪৩৭৪ রান! সর্বোচ্চ অপরাজিত ২০১! ১৯৮ লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তাঁর সংগ্রহ ২৬৭৮ রান।

উইকেট কিপার হিসাবেও সবসময় ছিলেন দুর্দান্ত! দ্রুত মুভমেন্ট ও সীদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে আজো তিনি হয়ে আছে দেশের সেরা উইকেট কিপার! বিশ্বের বড়বড় সব উইকেট কিপারদের সাথে তৎকালিন সময়ে তাঁর নামটি কেন উচ্চারিত হতো, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো তার টেষ্টে ৮৭ টি, ওয়ানডে তে ১২৬ টি ডিসমিসালের পরিসংখ্যান থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায়। এখানেই থেমে থাকেনি পাইলট কীর্তিগাঁথা! ২০০১ হতে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অধিনায়ক হয়ে বাংলাদেশ দলটাকে আগলে রাখা পাইলটের নাম যে মিশে আছে বাংলাদেশ এর বহু প্রথমের সাথে! বাংলাদেশের প্রথম সিরিজসেরা খেলোয়ার টির নাম যে খালেদ মাসুদ পাইলট! শ্রীলংকা দলের সাথে খেলা সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ হোয়াইট ওয়াশ হয়! এমনকি সে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও তিনি ছিলেন না! ছিলো মাত্র একটি অর্ধশতক, তাঁর রান যথাক্রমে ৫৪, ১৫ ও ৩৭! তবুও কেবলই অসাধারণ লড়াকু মানসিকতার জন্য তাঁর হাতেই ওঠে সিরিজসেরা খেলোয়ারের পুরস্কার! তিনিই হয় তো বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি কেবলই লড়াকু মানসিকতার কারনে সিরিজ সেরা হয়েছিলেন।

তাঁর লড়াকু এবং উজ্জ্বল মন মানসিকতার দেখা মেলে আরেকটি অনুসন্ধানে! দলের মধ্যে শৃংখলা বজায় রাখতে ও সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রতি সম্মান জানাতে, তিনি সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করেননি অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড! ক্রিকেট ইতিহাসে যার নজির খুব কমই মেলে! দেশসেরা এই ক্রিকেটারের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পটা বেশ মজার! বাবা জাতীয় দলের ফুটবলার। সেই সুত্রে ফুটবলই ছিল তাই পাইলটের ভালোবাসা।

কিন্তু ১৯৮৭ সালে হঠাৎই রাজশাহীর স্থাণীয় এক টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ হয় তাঁর।। প্রথম ম্যাচেই পেয়ে যান অর্ধশতকও! সেই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হন ১১ বছরের ছোট্ট পাইলট! এখান থেকেই শুরু হয়ে যাই পাইলটের সামনে এগিয়ে যাওয়া! ১৯৯৩ সালে সুযোগ মেলে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলে! ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নিজের আগমনের বার্তা দেন পাইলট! নিজ মেধা ও ক্রীড়াশৈলী দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করতে থাকা পাইলটকে তাই মূল দলে সুযোগ দিতে খুব বেশী ভাবতেও হয়নি নির্বাচকদের! এরপর থেকেই শুধু দেশের ক্রিকেটে নিত্যনতুন পালক সংযুক্ত করবার কাজটি নিরলস ভাবে করে গেছেন পাইলট।

যার শুরুটা হয় বিশ্বকাপের স্বর্ণালী টিকিট দিয়েই! বিশ্বক্রিকেট মঞ্চে যতদিন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়বে, বিশ্ব জয়ের আনন্দে যতবার বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি বিজয়োল্লাস করবে, আবেগে ভাসবে, আনন্দে হাসবে, ব্যাথায় কাঁদবে, যতদিন বাংলাদেশ, ক্রিকেটের সাফল্যে গর্বিত হবে, যতটাদিন ক্রিকেটের কল্যাণে বুক উচিয়ে সকল দেশের সব মানুষের সামনে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে, যতদিন বিশ্বকাপে সাকিব বা মাহমুদুল্লাহ বা মুশফিকের সেঞ্চুরিতে বাঙ্গালিদের গর্জন বঙ্গপোসাগর হয়ে কিংস্টন ওভাল আর লর্ডসে আঁছড়ে পরবে, তত দিন, ঠিক তত দিন, সবাইকে মনে রাখতেই হবে, এই মজবুত স্তম্ভ তৈরী করার পেছনে ছিল কয়েক জন সুপার হিউম্যান! আর রাজশাহীর পাইলট সেই সব সুপার সুপার হিউম্যানদেরই অন্যতম সেরা এবং সফল একজন!

স/আর