পত্নীতলায় খাদ্য সংকটে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার, খাবারের জন্য শিশুদের কান্না

আবু সাঈদ, পত্নীতলা:

শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টা। উপজেলা সদর নজিপুর হতে গগণপুর রোডে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লী সুলতানপুরে ঢুকতেই চোখে পড়লো ভাঙ্গাচোড়া ঘরের সামনের সামান্য ফাঁকা জায়গায় নারীরা কেউ চুলায় ভাত দিয়েছে আবার কেউ আলুবেগুন কাটছে। এদিক সেদিক পুরুষ ও শিশুকে ঘোরাফেরা করছে। এখানে একটা পুকুরকে কেন্দ্র করে চারিদিকে ১১৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভুঁইয়া সম্প্রদায়ের বাস।

মুল সড়ক হতে নেমে পল্লীতে এগিয়ে গিয়ে বাসরী ভুঁইয়া, গোলাপী ভুঁইয়াসহ আরো কয়েকজন নারীর সাথে কথা বললে তাঁরা জানান, হাতে কোন কাজ নেই তাই কেউ খাঁড়িতে মাছ ধরতে, কেউ গাছ থেকে খড়ি সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। তাদের ঘরে দুপুরের খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই। সকালে ভর্তা ভাত বা মুড়ি খেয়ে বাহিরে চলে যান, বিকেলে এসে ভাত রান্না করছেন, সন্ধ্যার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়বেন। এ সময় দেখা গেল বৃষ্টি নামে ৬/৭ বছর বয়সী একটি শিশু শুধু সাদা ভাত গিলছেন। ঘরে তরকারির কোন ব্যবস্থা নেই। পল্লীর ভিতরে ঢুকে অবাক না হয়ে পারা যায়না। যেখানে গরু-ছাগল রাখার মতো পরিবেশ নেই সেখানে কিভাবে মানুষ বাস করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

আনন্দ ভুঁইয়া, বাবুল ভুঁইয়া জানান, তাঁরা ৩পুরুষ ধরে এই জায়গায় বাস করছেন। তবে এই জায়গার মালিক তাঁরা নয়। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান করিমের ছেলেরা এই জমির মালিক। করিম চেয়ারম্যানের পিতা তাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। বর্তমানে করিম চেয়ারম্যানের ছেলেরা জায়গাগুলো বিক্রয় করছেন। জমির মালিক জমি বিক্রয় করলে তাঁরা কোথায় যাবেন জানেন না।

তাঁরা আরো জানান, তাদের মুলপেশা কৃষিকাজ। এছাড়াও তাঁরা নানারকম কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে হাতে কোন ক্জাই নেই। তাই কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে তাদের লোকজন দিন পার করছে। অনেকেই গৃহস্থদের কাছ থেকে আগাম শ্রম বিক্রয়ের টাকা নিচ্ছেন এবং উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করছেন বেচেঁ থাকার তাগিদে। করোনা ভাইরাসের কারণে তাদের জীবণ যাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি সরকারি ভাবে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হলে তাদের ১১৫টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ১জন খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মাঝে মাঝে তাদের পল্লীতে এলেও চেয়ারম্যান সাহেব ভোটের পর তাদের পল্লীতে এখনও পা দেয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।

হাতে কাদিয়া আর বস্তা নিয়ে মাঠে ঘাস কাটতে যাওয়ার সময় কথা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী বাসন্তি ভুঁইয়া, নিয়তি ভঁইয়ার সাথে। নিয়তি ভুঁইয়া জানান, সকালে আধাসের চালের ভাত রান্না করে স্বামী সন্তান মিলে ভাগ করে খেয়েছেন। রাতে কি রান্না হবে এখনও তিনি জানেন না। স্বামী কাজের সন্ধ্যানে সকালে বের হয়েছে। খাবার নিয়ে আসলে রান্না হবে অন্যথায় নয়। করোনার কারণে তাদের কাজকর্ম বন্ধ হওয়ায় ঠিকমতো খেতে পারছেন না। সন্তাররা খাবার জন্য কান্নাকাটি করছে।

এ অবস্থায় তাদের জীবণ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দয়া করে আপনারা আমাদের রক্ষা করেন। কিছু দিতে চাইলে দয়া করে নিজহাতে দিয়ে যান।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, পত্নীতলা উপজেলায় প্রায় ৮হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারের বাস। অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারই কাজ না থাকায় চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে। সম্প্রীতি সরকারিভাবে উপজেলার ১হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হলেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারের সমস্যাকে সেভাবে আমলে নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতা সুধির তির্কির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক খাদ্য সহায়তায় আমাদের জনগোষ্ঠীকে বিবেচনা করা হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা। এ সকল মানুষকে রক্ষার জন্য তিনি জরুরী ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন বিএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রউফ জানান, নওগাঁয় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষরা দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্র। সংকটকালীন সময়ে তারাই সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়ে থাকে। সুতরাং সরকারি খাদ্য সহায়তায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার প্রদান করা দরকার বলে মনে করছি।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাদ্য সংকট বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য রনজিত কুমারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন তিনি ১০টি কার্ড ভাগে পেয়েছেন। সুলতানপুরের ২ জনের নাম লিস্টে রেখেছি। তবে এই পল্লীর সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিটন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, পর্যায়ক্রমে সকলকে খাদ্য সরবরাহ করা হবে।

স/অ