নেতৃত্ব ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি নেতা মিনু: মিলনে আস্থা বুলবুলকে না

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী শহরের রাজনীতির কথা বলতেই একসময় উঠে আসতো মিজানুর রহমান মিনুর নাম। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি জোট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এই মিনু ছিলেন একদিকে এমপি, অপরদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র। আবার রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ওই সময় প্রতিদিন ভোর থেকেই নগরীর ভদ্রা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ক্ষমতাধর এই নেতার বাড়িতে থাকত শতশত নেতাকর্মীর ভীড়। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যেত। কিন্তু তার পরেও মিনুর সাক্ষাত পেতে বা একনজর দেখা করার জন্যেও চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতের শতশত নেতাকর্মী।
কেউ বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে, কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে, আবার কেউ ভিতরে প্রবেশের অনুমতি না পেয়েই বাইরে চিকন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেই মিনুর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতেন।

 

  • অপেক্ষারত এসব নেতাকর্মীরা চেয়ে থাকতেন কখন নেতা ঘুম থেকে উঠবেন, অথবা কখন ভিতর থেকে বের হবে বা কখন ঢাকা থেকে এসে পৌঁছাবেন, তার জন্য। কিন্তু মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানেই ২০০৭ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে মিনুর সেই ক্ষমতার দাপট। ২০০৯ সালে সেই মিনুর কাঁধেই রাজশাহী মহানহর বিএনপির সভাপতির দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেও দল ক্ষমতায় না থাকায় মিনুর বাড়িতে আগের মতো আর নেতাকর্মীদের ভীড় করতে দেখা যায়নি।

 

এমনকি মিনুর সেই রাজনৈতিক প্রভাবও কমতে থাকে দিনের পর। এরই ধারাাহিকতায় গত ২৭ ডিসেম্বর কেন্দ্র থেকে ঘোষিত রাজশাহী মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি থেকেও বাদ পড়ের সেই ক্ষমতাধর মিনু। তবে তার অনুসারী একটি অংশের নেতাকর্মীরা মিনুকে আবারো মহানগর বিএনপির পদে দেখতে চেয়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে থাকেন।

 
মহানগর বিএনপির বর্তমান সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের অনুসারীদের অভিযোগ, মিনু দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়েই সাধারণ সম্পাদক মিলনকে নিয়ে তিনি এখন মহানগর কার্যালয় দখলে রেখেছেন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জবনিকাপাত ঘটতে যাওয়া মিনুর ইন্ধনেই তাঁর অনুসারীরা বুলবুলকে দলীয় কার্যালয়ে ঢুকতে দিচ্ছেন না। বুলবুলকে বাইরে রেখেই সম্পাদক মিলনকে নিয়ে সভা করা ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন মিনু। এই অবস্থায় অনেকটা কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা চলছে বুলবুলকে।

 

  • দলীয় সূত্র সিল্ককসিটি নিউজকে বলছে, মিনুকে রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ থেকে বাদ দিয়ে বুলবুলকে সভাপতি করার  পরদিন মিনুর অনুসারীরা গত ২৮ ডিসেম্বর রাজশাহী মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে তালাও ঝুলিয়ে দেন। পরে ঢাকা থেকে মিনু রাজশাহীতে ফিরে এলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সেই তালা খুলে দেন মিনুর অনুসারি নেতাকর্মীরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন কমিটির সভাপতি ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বহিস্কৃত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং তাঁর অনুসারীদের মহানগর বিএনপি কার্যালয়ে ঢুকতে দেননি মিনু গ্রুপের নেতাকর্মীরা।

 

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনকে সঙ্গে নিয়েই মিনু এবং তাঁর অনুসারীরা কার্যালয়টি দখলে রেখেছেন। তাঁরা সেখানে সভাপতি বুলবুলতে ছাড়ায় কয়েকটি বৈঠকও করেছেন। সেখানে সভাপতিত্ব করেছেন সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। কিন্তু বুলবুলকে ডাকা হয়নি সেসব সভায়। এ নিয় ক্রমেই রাজশাহী মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে দ্বিধা-বিভক্তি।

 
বুলবুল গ্রুপের একাধিক নেতাকর্মী অভিযোগ করে সিল্কসিটি নিউজকে জানান, ২০০৯ সালেই মিনু কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁকে বাদ দিয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। সেই থেকেই রাজশাহী মহানগর বিএনপিতে মিনুর রাজনীতির জবনিকাপাত শুরু হতে থাকে। এরপর ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে পুনরায় বুলবুলকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হলে মিনু আরো কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন দলের নেতাকর্মীদের কাছে।

 

  • মিনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, বুলবুল যেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র না হতে পারেন, এর জন্য তিনি নেপথ্যে থেকে অনেক কলকাঠি নেড়েছেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তিনি জেল থেকেই ভিতরে ভিতরে বুলবুলের বিপক্ষে কাজ করেছিলেন বলেও সেসময় জনশ্রুতি ছিল। এরপর ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনেও বুলবুল যেন বিএনপির মনোনয়ন না পান, এর পেছনে তিনি কাজ করেছিলেন। মিনু চাইছিলেন বিএনপির নমিনেশন পাক তার আস্থাভাজন শফিকুল হক মিলন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দল বুলবুলেই আস্থা রাখেন। তারপরেও মিনু ও মিলন নির্বাচনে বুলবুলের হয়ে পুরো শক্তি দিয়ে কাজ করেননি বলেও ওই সময় অভিযোগ ছড়িয়ে পড়েছিল।

 

বুলবুল সমর্থকদের অভিযোগ, বুলবুল মেয়র হতে পারলে রাজশাহীতে মিনুর কর্তৃত্ব খর্ব হবে-এটা ভেবেই মিনু তার বিপক্ষে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেয়র নির্বাচিত হলে নেতাকর্মীরা ছুটতে থাকেন বুলবুলের বাড়ির দিকে। আর মিনুর বাড়িতে তখন খাঁ খাঁ অবস্থা শুরু হতে থাকে। এরই মধ্যে সাবেক সভাপতি মিনুকে বাদ দিয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর মহানগর বিএনপির সভাপতি হিসেবে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শফিকুল হক মিলনের নাম কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করে আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। এতে মিনুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কফিনে প্রায় শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয় বলেও মনে করছেন এখানকার নেতাকর্মীরা। কিন্তু সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন মিনু। তাঁর অনুসারীদের নিয়ে এবং মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আস্থাভাজন শফিকুল হক মিলনকে সঙ্গে নিয়ে দলীয় কার্যালয় দখল করে সেখানে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করা ছাড়ায় নানা কর্মসুচি পালন করছেন মিনু।

 

  • সর্বশেষ গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুস্পস্তব অর্পন কর্মসূচিতেও বুলবুলকে ছাড়াই মিলন এবং নিজের অনুসারীদেরকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারে যান মিনু। অপরদিকে বুলবুল তাঁর অনুসারীদের নিয়ে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কেনো ভেদাভেদ নেই, কোন্দলও নেই। কমিটি ঘোষণার পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলেও তা এখন নিরসন হতে চলেছে। তবে শহীদ মিনারে আলাদাভাবে ফুল দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান মিনু।

 

  • তবে নতুন কমিটির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে ইঙ্গিত করে সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝিয়ে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতির পর চেয়ারপারসনের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। তিনি সব ঠিক করে দিবেন বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন।

 

এদিকে দলের এ বিভেদ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘দলের সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে। আমরা একসঙ্গেই কাজ করতে চাই। কিন্তু এখনো কিছু নেতাকর্মী দলের বিভেদ তৈরীতে সচেষ্ট। এসব নিয়ে কেন্দ্রেও জানানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত বিষয়টির সমাধান হবে।’

 
প্রসঙ্গত, গত ২৭ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা ও মহানগরের নতুন কমিটির ঘোষণা করা হয় কেন্দ্র থেকে। এর পরের দিন ২৮ ডিসেম্বর রাজশাহী মহানগর বিএনপি অফিসে তালা ঝুলানো হয়। সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মিনুর সমর্থকরা তালা ঝুলিয়ে দেন।

স/আর