নেতাকর্মীদের হতাশা কাটানো বড় চ্যালেঞ্জ বিএনপির

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বিঘ্নে সরকার গঠন করায় বিএনপিদলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা চেপে বসেছে। এই হতাশা কাটিয়ে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে রাজপথের কর্মসূচিতেফেরানো বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির নেতারা।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মনে করেন, বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মানুষ ভোটদান থেকে বিরত ছিল। এতে করে তাদের ধারণা ছিল এমন নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র চাপে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু নেতাকর্মীদের সেই ধারণা পাল্টে যেতে বসেছে। তাদের মাঝে নতুন ধারণা জন্মেছে, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার আগামী পাঁচ বছরই টিকে থাকবে।

এই অবস্থায় নেতাকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে সাংগঠনিক শক্তি ধরে রেখে দীর্ঘমেয়াদে রাজপথে টিকে থাকতে হবে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আইনি জটিলতায় রাজনীতি থেকে দূরে, অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে দল পরিচালনা করলেও তার সব সিদ্ধান্ত সব সময় সঠিক না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে। দীর্ঘ আন্দোলন ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাসহ নানা চাপের কারণে নেতাকর্মীদের আয়ের পথ অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। আর্থিক দুরবস্থা এমন জায়গায় গেছে, মামলা ও পরিবারের ব্যয় মিটাতে গিয়ে এখন সচ্ছল নেতাকর্মীরাও হিমশিম খাচ্ছেন। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক নেতাকর্মী রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, দলীয় নেতাকর্মীকে

সক্রিয় করতে হলে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে যা যা প্রয়োজন, সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বিএনপিকে। দলের জাতীয় কাউন্সিল করাসহ প্রতিটি কমিটি গঠনে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে সৎ ও যোগ্যদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। এ ছাড়া গণমুখী কর্মসূচিও পালন করতে হবে বিএনপিকে।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপি দেশবাসীকে ৭ জানুয়ারি ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল। দেশের মানুষ তাতে সাড়া দিয়ে ভোট দিতে যায়নি। এটা আমাদের অহিংস আন্দোলনের বড় সফলতা। এ সফলতাই আমাদের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নেবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্থায়ীভাবে হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

দলের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করেন, ওয়ান-ইলেভেনের পরও অনেকে বলেছিল বিএনপি টিকে থাকতে পারবে না। অথচ সেই বিএনপি এখন দেশের ‘সবচেয়ে জনপ্রিয়’ রাজনৈতিক দল। বিগত আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের ভূমিকা, তাদের যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে সংগঠন পুনর্গঠন এবং দলের জাতীয় কাউন্সিলের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। বাংলাদেশের সব সিদ্ধান্ত হয় এখন দেশের বাইরে থেকে। গুরুত্বপূর্ণ দেশ সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়গুলো আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে।’

বছরের মাঝামাঝিতে কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মাসের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির এক ভার্চুয়াল সভায় দলের জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর আগে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ নিয়ে আলোচনা করেন। দলের জাতীয় কাউন্সিল নিয়ে শীর্ষপর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তাও শুরু হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একটি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মাঝামাঝি দলের জাতীয় কাউন্সিল করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের মনোভাবের ওপরও নজর রাখছে দলটি। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিগত আন্দোলনে যারা দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, দল পুনর্গঠনের মাধ্যমে তাদের মূল্যায়ন করা হবে।

আপাতত পুনর্গঠনে নজর : দলীয় সূত্র জানায়, গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল পুনর্গঠনের ওপর নজর দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে গত ১ মার্চ বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাত সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে দলটি। জাতীয়তাবাদী যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল পুনর্গঠন নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে। জানা গেছে, সংগঠনের বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদ নিশ্চিত করে যুবদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। নতুন কমিটির জন্য আলোচনায় আছেন বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্না, সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, গোলাম মাওলা শাহীন, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, সাবেক সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলসহ বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় আছে।

অন্যদিকে, স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্তমান কমিটির সভাপতি এসএম জিলানীকে বিএনপিতে পদায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটির জন্য আলোচনায় আছেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, সহ-সভাপতি ইয়াছিন আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান। বর্তমান কমিটির বাইরে বিএনপির সহ-পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সহ-সম্পাদক বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুনসহ আরও বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় আছে।

কূটনীতিতেও নজর : শুধু দল পুনর্গঠন নয়; পরাশক্তি দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কূটনৈতিক কৌশল ঠিক করতে যাচ্ছে বিএনপি। এ নিয়ে খুব দ্রুত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হবে। যদিও ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার সমালোচনা করে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছে দলটির নেতারা। সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর চীনসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের বৈঠক হয়েছে। ওই আলোচনা থেকে দলটির নেতাদের মনে হয়েছে, বিএনপির বিষয়ে চীনের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বিএনপিও পূর্বমুখী কূটনীতি জোরদার করতে আগ্রহী।

জনসম্পৃক্ত অহিংস কর্মসূচি চলবে : সূত্র আরও জানায়, এখন আপাতত বড় কোনো কর্মসূচিতে না গেলেও জনসম্পৃক্ত অহিংস কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বিএনপি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের লোডশেডিংসহ নানা ইস্যুতে কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে। ঈদের পর যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এসব কর্মসূচি পালন করবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলবে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।’