নিম্নমানের কাগজে পাঠ্য বই, ছয় মাস না যেতেই পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্য বই তুলে দেওয়া সরকারের অন্যতম অর্জন। কিন্তু এই অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। নিম্নমানের কাগজে ছাপা হচ্ছে আগামী শিক্ষাবর্ষের বেশির ভাগ পাঠ্য বই। এতে বইয়ের স্থায়িত্ব কম হবে ও ছাপা স্পষ্ট হবে না। ছয় মাস যেতে না যেতেই বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত এবার প্রায় ৩৫ কোটি বিনা মূল্যের বই ছাপা হচ্ছে। বর্তমানে কাজ পাওয়া মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান পুরোদমে বই ছাপানো, বাঁধাইসহ নানা কাজে ব্যস্ত রয়েছে। মাধ্যমিকের একটি অংশের বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছতে শুরু করেছে। প্রাথমিক, ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের গ্রামার বইগুলো ছাপানোর কার্যাদেশ যারা পায় তারাই কাগজ সংগ্রহ করে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যান্য সব বইয়ের কাগজ সরবরাহ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এনসিটিবি কাগজের মান ঠিক রাখার জন্য দরপত্রে স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করে দেয়। কিন্তু এবার এনসিটিবি ও মুদ্রণকারীদের কেনা কাগজের বেশির ভাগেরই মান ঠিক নেই। দরপত্রের কারিগরি নির্দেশনা ও নিয়ম মোতাবেক ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) থাকা দরকার ৮৫ শতাংশ, কিন্তু রয়েছে মাত্র ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। একইভাবে কাগজের পুরত্ব (জিএসএম) ৬০ থেকে ৬৪ শতাংশের মধ্যে থাকার কথা থাকলেও আছে অনেক কম। আর ব্যবহৃত কাগজ কতখানি মজবুত তার নির্দেশনাকারী ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ যেখানে ন্যূনতম ১২ শতাংশ থাকার কথা, তা আছে ৮ শতাংশের কাছাকাছি।

সূত্র জানায়, কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কম টাকায় নিম্নমানের কাগজ কিনছে। এনসিটিবির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী, ভালো মানের ব্রাইটনেসযুক্ত কাগজ কিনতে প্রতি টনে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা দরকার। কিন্তু বেশির ভাগ মুদ্রণকারীই ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা টনে নিম্নমানের কাগজ কিনে বই ছাপাচ্ছে।

জানা যায়, বিনা মূল্যের পাঠ্য বই ছাপানো একটি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন মুদ্রণকারী ও এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তা। তাঁরাই নিম্নমানের কাগজে বই ছাপছেন। আর নিম্নমানের কাগজে ছাপা বই মূলত বছরের শেষ সময়ে সরবরাহ করা হয়। তখন আর বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় থাকে না।

একটি কাগজ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাগজ সরবরাহে ও মুদ্রণে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন আল নূর, সৈয়দপুর ইকো পেপার মিলস, ইথিক্যাল পাল্প ও পেপার লিমিটেড, বেস পেপারস লিমিটেড এবং বিসিএল পেপার মিলস লিমিটেড। এ ছাড়া বেশি কাজ পাওয়া কিছু মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানও এই সিন্ডিকেটে রয়েছে। আর এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তা নানা সুবিধার বিনিময়ে এই নিম্নমানের কাগজ দেখেও না দেখার ভান করেন।

বই ছাপানোর দায়িত্ব পাওয়া একটি প্রিন্টার্সের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, এনসিটিবি থেকে যে কাগজ তাঁদের দেওয়া হয়েছে তার মান একেবারেই খারাপ। বিষয়টি তাঁরা জানিয়েছেন। কিন্তু এই কাগজেই কাজ চালিয়ে নিতে বলা হয়েছে।

এনসিটিবিরই একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন এখন বেশ সক্রিয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম তারা ধরছে। এখন এনসিটিবির বই মুদ্রণ ও কাগজের মান নিয়েও অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে অনেক দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।

জানা যায়, দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির চাহিদা মোতাবেক কাগজ প্রস্তুত করতে পারে। অথচ তাদের সাধারণত কাগজ সরবরাহের কাজ দেওয়া হয় না। কারণ তারা কখনো মানের সঙ্গে আপস করবে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিবছরই ঘুরে ফিরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির মোট কাজের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাগিয়ে নেয়। তাদের একেকজন পাঁচ-সাতটি প্রেসের নাম ব্যবহার করে। তারাই মূলত নিম্নমানের কাগজ বেশি ব্যবহার করে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির পরীক্ষায়ই নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নমানের কাগজ মূলত নিউজপ্রিন্ট। রিসাইক্লিং কাগজের পাল্প দিয়ে তা তৈরি করা হয়। পাঠ্যপুস্তকের মান রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এজেন্সি এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে নিম্নমানের কাগজে ছাপানো বইকেও সঠিক বলে চালিয়ে দেয়।

এসব বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ইতিমধ্যে বই পৌঁছাতে শুরু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কাগজের মানের ব্যাপারে আমরা কোনো সমস্যা পাইনি। কারণ আগে কাগজ ইন্সপেকশন হয়, এরপর ছাপার জন্য যায়। আশা করছি, এবার নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বই ছাপার কাজ শেষ করতে পারব।’

সম্প্রতি এনসিটিবিতেই এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছিলেন, বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। বইয়ের মানের সঙ্গে কোনো আপস করা হবে না।