নিভে গেল ওই পরিবারের বাতি, নিমিশেই শেষ হয়ে গেল সবকিছু!

এস এম শফিকুল ইসলাম, জয়পুরহাট:
“শীতের রাত সাড়ে ৯টা মানেই অনেক। গত কয়েক রাতের চেয়ে বুধবার রাতে শীত ছিল একটু বেশী। তারপর ছিল শ্যামা পূজা উপলক্ষে এলাকায় বড় বড় গ্রাম্য মেলা। শহর ছিল মোটামুটি জনশূণ্য। যাও ছিল কয়েকজন, তারাও আবার আড্ডা দেওয়ার লোকজন না পাওয়ায় আগেভাগেই ওই রাতে যে যার মত করে বাসায় ঢোকে।

হঠাৎ করে রাত ১০ টার দিকে শহরের ভিতরে এ্যালোমেলো ভাবে এ্যাম্বোলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস গাড়ীর সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। তখন মনে হলো যেন ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। এমনটাই মনে করে তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে উঠে এসে রাস্তায় দেখতে পেলাম লোকজনের ছোটাছুটি। পিছু ধরে আমিও গেলাম তাদের সাথে। গিয়ে দেখি একটি বাড়ীতে আগুন জ্বলছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে, আমিও দাড়ালাম। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন নেভানোর চেষ্ঠা করছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই আগুনের গতিও কমে আসলো। পরে দেখতে পেলাম ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এক এক করে সবাইকে ওই বাড়ীর ভিতর থেকে দগ্ধ অবস্থায় বের করে নিয়ে আসছেন। তখন মনে হলো ওরা সবাই মারা গেছে। নিভে গেল ওই পরিবারের বাতি। নিমিশেই শেষ হয়ে গেল সবকিছু।

এভাবেই ওই ঘটনার লোমহর্ষক বিবরণ করছিলেন প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষদর্শী সেলিম হোসেন।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া গৃহকর্তা আব্দুল মোমিনের চাচাত ভাই ও তাদের একমাত্র স্বজন জাকির হোসেন ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বাড়ী একটি গ্রামে। এখান থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরে। রাতে আগুন লাগার কথা শুনে সাথে সাথে ছুটে এসে দেখি সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এরপর তিনি হৃদয়বিদারক আর মর্মস্পর্শী আহাজারি করতে থাকেন। তার কান্নায় চোখের পানিতে ভিজে গেছে বুক। কান্না দেখে থামাতে পারেনি অন্যরাও।

বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৯ টার দিকে জয়পুরহাটের আরামনগর মহল্লার একটি বাড়িতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে যাওয়ায় ৮ সদস্যের একটি পরিবারের সকলেই পর্যায়ক্রমে নিহত হয়েছেন। বর্তমানে কেউ জীবিত নেই ওই পরিবারে।

আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন তাদের মধ্যে ৩ জনকে মৃত এবং ৫ জনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরে দগ্ধ অবস্থায় ৫ জনকে জয়পুরহাট আধুনিক হাসপাতালে পাঠান। দগ্ধ ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় রাতেই চিকিৎসকরা তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সেখানে নেওয়ার পথে ওই ৫ জনের মধ্যে ৪ জন টাঙ্গাইল এলাকা মারা যায়। সেখান থেকে তাদের জয়পুরহাটে নিয়ে আসা হয়। আরেকজন মারা যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটে। এ ঘটনায় ৮ সদস্যের একটি সাজানো পরিবারের সকলেই মারা যায়।

পরিবারের নিহতরা হলেন, বাড়ির গৃহকর্তা আব্দুল মোমিন, বড় মেয়ে বৃষ্টি, মোমিনের মা মোমেনা বেগম, মোমিনের বাবা দুলাল হোসেন, স্ত্রী পরীনা বেগম, জমজ দুই মেয়ে হাসি ও খুশি এবং ছোট ছেলে তাইমুল ইসলাম নুর। দূর্ঘটনায় একই পরিবারের ৮ সদস্যে মারা যাওয়ায় শহরের আরামনগর এলাকায় তাদেরকে এক নজর দেখতে হাজার হাজার জনতা ভিড় করে। সাধারণ মানুষের চখের পানিতে ভিজে গেছে সবার বুক। এ ঘটনায় ওই এলাকায় পরিবারের ৮ সদস্যের লাশ আশার পর প্রতিবেশী ও সাধারণ মানুষের বুকভাঙ্গা কান্নায় এলাকার বাতাসও ভারি হয়ে উঠে। কেউ মেনে নিতে পারছেননা লোমহর্শক এমন ঘটনা।

এ দিকে ওই পরিবারের মৃত ৮ জন সদস্যের মধ্যে প্রথমে ৫ জনের যানাযা নামাজ জয়পুরহাট শহীদ জিয়া কলেজ মাঠে বাদ যহর অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে বাদ আছর কেন্দ্রীয় ঈদ গাঁ মাঠে আরও ৩ জনের যানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তাদের যানাযা নামাজে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারসহ হাজার হাজার জনগন অংশগ্রহন করেন।

জয়পুরহাট ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সিরাজুল ইসলাম জানান, বুধবার রাত সাড়ে ৯ টার দিকে মুরগী ব্যবসায়ী মোমিনের বাড়িতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সুত্রপাত ঘটে। মুহুর্তেই তা পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গৃহকর্তা আব্দুল মোমিন, তার মা মোমেনা বেগম ও বড় মেয়ে জেএসসি পরীক্ষার্থী বৃষ্টি বেগম ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ঘটনায় পরিবারের গুরুতর আহত অবস্থায় অন্য ৫ জনকে ঘটনাস্থ থেকে উদ্ধার করে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকরা তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সেখানে যাওয়ার পথে ৪ জন মারা যায়। পরে ঢাকায় গিয়ে আরও ১ জন মারা যায়। ফলে এ ঘটনায় ওই পরিবারের ৮ সদস্যেই মারা যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।
জয়পুরহাট আধুনিক হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম জানান, যে ৫ জনকে দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছিল, তাদের শরীরের ৭৫ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। তারা সবাই আশঙ্কানজক ছিল। সে কারণে রাতেই তাদেরকে ঢাকাতে স্থানান্তর করা হয়।

এ বিষয়ে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার রশিদুল হাসান বলেন, কি ভাবে এত বড় ঘটনা ঘটলো এবং একই পরিবারের এক সাথে ৮ জনের মৃত্যু হলো, সে বিষয় খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উজ্জল কুমার রায়কে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত শুরুও করেছেন।

জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন বলেন, আসলে এ ঘটনা মেনে নেওয়ার মত নয়। হৃদয় বিদারক। এ ঘটনার মূল রহস্য বের করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পৃথক ৩ সদস্যের আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ঘটনার পরপরই জয়পুরহাট-২ আসনের সাংসদ, জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং তারা পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার এ ঘটনায় পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টেট সোনিয়া বিনতে তাবিব কে প্রধান করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুস সালাম ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন চন্দ্র রায়কে সদস্য করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি ৭২ ঘন্টার মধ্যে আগুন লাগার প্রকৃত ঘটনা উৎঘটন করতে নির্দেশ দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, অগ্নিকান্ড ঘটনায় চিকিৎসার জন্য বুধবার রাতে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয় এবং তাদেরকে সহযোগীতা করার জন্য ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ত্রান ও পূর্ণবাসন ফান্ডে জমা রয়েছে। নিহতদের পরিবারের নিকট কারও ঋণ-দেনা পাওনা থাকে তাহলে এ ফান্ড থেকে পরিশোধ করা করা হবে।

এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উজ্জল কুমার রায়কে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান।

এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর পক্ষ থেকে উপ-সহকারী পরিচালক (বগুড়া) নিজাম উদ্দিন প্রধান করে ৩ সদস্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ৭ কার্য দিবসের মধ্যে আগুন লাগার প্রকৃত ঘটনা উৎঘটন করতে কাজ করবে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর জয়পুরহাট স্টেশন ইনচার্জ সিরাজুল ইসলাম।

ভিডিও…

স/অ