নাটোরে বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা এবং অনিয়মের অভিযোগ

মাহাবুব হোসেন, নাটোর:
নাটোরের সাতটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ে এক’শ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আর যাচাই-বাছাই কমিটির দ্বিধা-বিভক্তি মতামত থাকায় অপেক্ষমান তালিকায় রাখা হয়েছে আরো অর্ধ শতাধিক জনকে। তবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশের দিন তালিকা দেখে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্বাক্ষ্য প্রমান দেওয়ার পরও অনেকের তালিকায় নাম না আসায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের স্বজনরা।

 

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির বেশির ভাগ সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, আর্থিক সুবিধা সহ নানা অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অর্থের বিনিময়ে অনেক অমুক্তিযোদ্ধকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া বাছাই কমিটির কিছু কিছু সদস্যের বিরুদ্ধো ১৯৭১ সালে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মালামাল লুটপাট, তাদের
সম্পত্তি অবৈধ দখলের অভিযোগ রয়েছে।


মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে জেলার সর্বশেষ সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শেষে  ৩৩জনের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। শনিবার বিকেল ৫টার দিকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আরিফ মোহাম্মাদ স্বাক্ষরিত তালিকাগুলো প্রকাশ করা হয়। এছাড়া ১৪জনের নাম অপেক্ষমান তালিকায় রাখা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশের দিন তালিকা দেখে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া স্বাক্ষ্য প্রমান দেওয়ার পরও অনেকের তালিকায় নাম না আসায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের স্বজনরা।

সারা দেশের মতো নাটোরের ৭টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়। গত ১১ থেকে ১৪ ফেব্র“য়ারী পর্যন্ত নাটোর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শেষ করা হয়। সে সময় যাচাই-বাছাই কমিটির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেন মুক্তিযোদ্ধা সহ আবেদনকারীর স্বজনরা। টাকার বিনিময়ে স্বাক্ষী ক্রয় করে অমুক্তিযোদ্ধারাও আবেদন করে বলে সে সময় অভিযোগ উঠে।
নাটোর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আরিফ মোহাম্মাদ বলেন, সকল তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে ৩৩জন মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। বাঁকি ১৪জনের বিষয়ে দ্বিধা-বিভক্তি মোতামত থাকায় তাদেরকে অপেক্ষামান তালিকা অন্তভুক্ত করা
হয়েছে।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে সে সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন সিল্কসিটি নিউজ বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম একাই তিনটি পদে ছিলেন। যার কারনে যাচাই-বাছাই সঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

 

সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা-বাছাইয়ে নাটোর সদর উপজেলায় ৯শতাধিক ব্যাক্তি আবেদন করেন, এর মধ্যে নাম প্রকাশ করা হয়েছে ৩৩জনের, আর অপেক্ষমান তালিকায় রয়েছে ১৪জন, সিংড়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন ৫’শ ৫৭জন, এর মধ্যে তালিকা নাম প্রকাশ করা হয়েছে ৪৪জনের, আর অপেক্ষমান তালিকায় রয়েছে ১৬জন, লালপুর উপজেলায় অনলাইনে আবেদন করেন ২’শ ৫৬জন, এর মধ্যে তালিকায় নাম প্রকাশ করা হয়েছে ১৫জনের, গুরুদাসপুরে অনলাইনে আবেদন করেন ১৫৩, এর মধ্যে নাম প্রকাশ করা হয়েছে ৪জনের এবং বাগাতিপাড়ায় অনলাইনের আবেদন করেন ৩’শ ৫৪ এরমধ্যে তালিকা প্রকাশ করা হয় মাত্র ৪ জনের।

 

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশ এবং যাচাই-বাছাই নিয়ে বেশির ভাগ উপজেলায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে গুরুদাসপুর, লালপুর এবং নাটোর সদর উপজেলা অন্যতম।

গত ৯ ফেব্র“য়ারী নাটোরের লালপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে অনিয়ম ও ইউএনও বিরুদ্ধে অশোভন আচরণের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযোদ্ধারা। নাটোর শহরের ফুলবাগান এলাকায় সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলেন  যুদ্ধকালীন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক।


এসময় লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম যাচাই বাছাইয়ের সময় লাল বইয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে দেন নাই। ভারতীয় তালিকার সনদ গ্রহন করেন নি, এমনকি ভারতীয় ক্যাম্পের সনদ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন তিনি। স্বাক্ষিদের ঠিকমত স্বাক্ষ্য দেয়ার সুযোগ দেননি বলেও অভিযোগ করা হয়। এই অবস্থায় উক্ত যাচাই বাছাই বাতিল করে পূনঃযাচাই বাছাইয়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর
কাছে জোর দাবি জানানো হয় সে সময়।
সে সময়  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করার জন্য যে গাইড লাইন ছিলো, সেটা অনুসরন করেই যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। কেউ সংক্ষুদ্ধ হয়ে এই ধরনের অভিযোগ করতে পারে।

 
অপরদিকে, গত শুক্রবার ২৪ ফেব্রুয়ারী গুরুদাসপুরে বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধা নিয়ে দুই জন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অভিযোগ উঠেছে। বাছাই কমিটির বাইরে থাকা ৬৩জন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংবাদ সম্মেলন ডেকে এমন অভিযোগ করেন।

 

বিতর্কিত বাছাই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাছাই কার্যক্রমের দাবীসহ  টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষে দোষী সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবীও করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
খোঁজনিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সাংসদ আবদুল কুদ্দুস মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় পদাধিকার বলে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. ইয়াসমিন আক্তার সদস্য সচিব ছিলেন। সাংসদ দেশের বাইরে
থাকায় পদাধিকার বলে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আনোয়ার হোসেন বাছাই কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ওই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, নাটোর জেলা ডেপুটি কমান্ডার আবু তালেব, অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন, মো. সাইফুল ইসলাম ও জাবেদ মাসুদ (আখের)।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত অভিযোগে দাবী করা হয়, ওই বাছাই কমিটির কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধা নিয়ে আবদুল গফুর ও রইস উদ্দিন নামে দুই অমুক্তিযোদ্ধাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

 

বাছাই কমিটির সদস্য জাবেদ মাসুদ আখের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জন্য কারো কাছে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

 
বাছাই কমিটির অপর সদস্য সাইফুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে গুরুদাসপুর বাজারের হিন্দুদের বাড়িঘর ও মালামাল লুটপাট, তাদের সম্পত্তি অবৈধ দখলসহ তারা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এসব অপকর্ম ঢাকতে পরে তিনি ভারতে চলেযান।

 

বাছাই কমিটির অপর সদস্য সাইফুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সে সময় তিনি লুটপাট প্রতিহত করতে গিয়ে তারা নামের ওই ব্যাক্তি খুন হয়েছিল সত্য। এনিয়ে কোন মামলা হয়নি। তবে হিন্দুদের জায়গা দখল, বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগ সত্য নয়। প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনছেন।

 
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ও গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. ইয়াসমিন আক্তার সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত কমিটি দ্বারা বাছাই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কোন সদস্য বিশেষ সুবিধা নিয়ে অনৈতিক কাজ করলে দায়ভার তাঁকেই বহন করতে হবে।

স/শ