নব্য জেএমবির অর্থদাতা রোকন জাহিদ তানভীর

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া নব্য জেএমবির তহবিলের প্রধান অর্থদাতা ওই সংগঠনেরই নেতৃস্থানীয় কয়েক ব্যক্তি। মূলত নাশকতা চালানোর লক্ষ্যেই ওই তহবিল গঠন করা হয়।

 

নব্য জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগদানকারী চিকিৎসক রোকনুদ্দীন খন্দকার একাই ৮০ লাখ টাকা দিয়েছেন। গত ১০ জুলাই সপরিবারে সিরিয়ায় যাওয়ার আগে নব্য জেএমবির তহবিলে দেওয়ার জন্য এই ৮০ লাখ টাকা তিনি তাঁর স্বজন ও সহযোগীদের কাছে দিয়ে যান।

 

রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার সময় পেনশন বাবদ পাওয়া কোটি টাকার পুরোটাই দিয়ে দেন জঙ্গি তহবিলে। আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত তানভীর কাদেরী উত্তরায় তাঁর ফ্ল্যাট বিক্রি করে পাওয়া প্রায় কোটি টাকা দান করেন নব্য জেএমবির তহবিলে।

 

এ ছাড়া দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ১৪ লাখ টাকা আসে। রাজধানীর গুলশানে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার খরচ মেটানো হয় ওই তহবিল থেকেই। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট এসব তথ্য জানিয়েছে।

 

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ডা. রোকনসহ তিনজনের তহবিল গঠনের ব্যাপারে জানান। পরে তিনি বলেন, ডা. রোকন যাদের কাছে টাকা দিয়েছিলেন তারা পুরো টাকা সংগঠনের তহবিলে দেয়নি।

 

অন্যদিকে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, আশুলিয়ায় অভিযানের সময় নিহত আবদুর রহমান ওরফে নাজমুল হোসেনসহ অন্তত ১২ জন ৩০ লাখ টাকা অর্থায়ন করে নব্য জেএমবির তহবিলে। তবে এখনো প্রকৃত নাম-পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় রহমানের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি সিটিটিসি ইউনিট।

 

সিটিটিসি ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া টাকা খরচ করেই গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ১৪ লাখ টাকা আসে, যা তামিমসহ অন্য জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে। তামিম ছাড়া পলাতক জঙ্গি বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ওরফে রাহুল টাকা সংগ্রহ করে।

 

এক কর্মকর্তা জানান, এ পর্যন্ত তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়নি। দেশীয় উেসর টাকায়ই এসব হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। বিদেশি উৎস থেকে নব্য জেএমবির কাজের জন্য কিছু অর্থ আসারও তথ্য মিলেছে।

 

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গুলশান হামলাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নব্য জেএমবির অর্থসংস্থানের ব্যাপারে আমরা বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। সপরিবারে সিরিয়ায় যাওয়ার আগে ডা. রোকন ৮০ লাখ টাকা দিয়ে গেছেন। দেশে থাকা অবস্থায় নব্য জেএমবির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়। দেশ ছাড়ার আগে টাকা দিয়ে সংগঠনের কাজে ব্যবহারের কথা বলে যান তিনি। তবে যাদের দিয়েছেন তারা পুরো টাকা সংগঠনে দেয়নি।’

 

মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘নিহত জঙ্গি মেজর (অব.) জাহিদ তাঁর পেনশনের পুরো টাকা দিয়েছেন। একইভাবে তানভীর কাদেরী তাঁর উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রি করে টাকা দেন।’

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প্রায় ১৪ লাখ টাকা বাশারুজ্জামান গ্রহণ করেন। এগুলোও ব্যবহার করা হয়েছে। গুলশানে হামলা বা শোলাকিয়ার ঘটনায় বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়নি। ফলে ধারণা করছি, এসব টাকায়ই তারা চলেছে। বড় অঙ্কের বিদেশি কোনো অর্থায়নের তথ্য মেলেনি। এ বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে।’

 

সিটিটিসি ইউনিট সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় ঈদ উদ্যাপন করার কথা বলে গত ১০ জুলাই পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়েন ডা. রোকনুদ্দিন খন্দকার। তিনি ছিলেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বিভাগের স্লিপিং ডিসঅর্ডারের চিকিৎসক। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি ওই চাকরিতে ইস্তফা দেন।

 

তাঁর স্ত্রী নাইমা আক্তার নিলু যশোর সরকারি এমএম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। দেশ ছাড়ার আগে তিনি বিদেশে ভ্রমণ করবেন বলে কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজেও শিক্ষকতা করেন। তাঁদের সঙ্গে দেশ ছাড়ে দুই মেয়ে রেজোয়ানা রোকন ও রামিতা রোকন এবং রেজোয়ানার স্বামী সাদ কায়েস ওরফে শিশির। রোকন রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় তাঁর ৪১১/বি নম্বর পাঁচতলা ভবন, চেম্বারসহ বেশ কিছু সম্পত্তিও স্বজনদের দান করে যান। বড় মেয়ে রেজোয়ানা রোকন ও তাঁর স্বামী সাদ কায়েস শিশির নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে পড়তেন। ২০১৪ সালের মার্চে তাঁরা নিজেরাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শিশিরের বাড়ি শনির আখড়া এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেনের পাশে। ডা. রোকনের ছোট মেয়ে রামিতা রোকন ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিল। তবে পরীক্ষার আগেই সে মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যায়।

 

সূত্র মতে, পরিবার নিয়ে মালয়েশিয়া হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমান ডা. রোকন। তারা এখন রাকা শহরে আইএস ঘাঁটিতে অবস্থান করছে। সেখানে আইএস জঙ্গিদের শিশুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন রোকন। তাঁর স্ত্রী নাইমা আইএস মতাদর্শীদের শিক্ষাবিষয়ক কাজে সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশে অবস্থানকারী নব্য জেএমবির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব তথ্য জানান রোকন।

 

সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর উত্তরায় অবস্থানকালে মেজর (অব.) জাহিদ নব্য জেএমবির আদর্শ গ্রহণ করেন। এরপর তামিম চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কথিত জিহাদে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি পেশাগত জীবন ও পরিবার ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। ওই সময় তাঁর পেনশনের পুরো টাকা তিনি সংগঠনে দেন। এসব টাকা তামিম ও আস্তানার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা গ্রহণ করে। জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা এখনো পলাতক।

 

আজিমপুরে নিহত তানভীর কাদেরী পরিবার নিয়ে উত্তরায় ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাড়িতে নিজ ফ্ল্যাটে থাকতেন। নব্য জেএমবিতে যুক্ত হওয়ার পর ওই ফ্ল্যাট বিক্রি করে তিনি রূপনগরে চলে যান। ফ্ল্যাট বিক্রির পুরো টাকাই সংগঠনে বিনিয়োগ করেন তিনি। এরপর বারিধারা হয়ে সর্বশেষ আজিমপুরে লালবাগ রোডের ২০৯/৫ নম্বর বাসায় ছিলেন।

 

তানভীর কাদেরী আগে ডাচ্-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং, রবি ও কল্লোল গ্রুপে এবং তাঁর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা মুসলিম এইড, সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরি করেছেন। ফলে তাঁদের ব্যাংক হিসাবেও বেশ কিছু টাকা ছিল। আবেদাতুল ফাতেমা আজিমপুর থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

 

সূত্র মতে, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার ওরফে রাহুল ওরফে চকলেট অনেক দিন ধরে নিখোঁজ। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বাশারুজ্জামান এখন নব্য জেএমবির অর্থ ও পরিকল্পনার সমন্বয়ক। হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ১৪ লাখ টাকার একটি চালান তিনিই গ্রহণ করেন। আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তাঁর স্ত্রী শায়লা আফরিনও গত সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

 

এদিকে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, আশুলিয়ার বাইপাইলে অভিযানের পর নব্য জেএমবির তহবিলে অর্থায়নকারী অন্তত ১২ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, অভিযানের সময় ভবন থেকে পড়ে নিহত আব্দুর রহমানের প্রকৃত পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তিনি রহমান ছাড়াও এনামুল, মুক্তার, নাজমুল, সরোয়ার, বাবু, রকিবুল ও প্রকাশ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন তিনি। তাঁর স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রুমিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ৩০ লাখ টাকা উদ্ধার করার পর নব্য জেএমবির অর্থদাতাদের ব্যাপারে তথ্য মেলে।

 

এসব অর্থদাতার ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আব্দুর রহমান বা এ রকম কারো অর্থায়নের তথ্য আমরা পাইনি। জেনেছি, ওই ব্যক্তির নাম-পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হয়ত সেও অর্থদাতাদের কেউ হতে পারে।’

সূত্র: কালের কন্ঠ