নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষে সাফল্যের হাতছানি

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ :
সরকারি ভাবে এই প্রথম নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার আত্রাই নদে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়েছে। সরকারের পাশাপশি স্থানীয় ভাবে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মৎস্য চাষিরা । এলাকায় মাছ চাষের নতুন এই পদ্ধতি দেখে স্থানীয় বেকার যুবক ও ভূমিহীন মৎস্যজীবীরা নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মাছ চাষি ও আগ্রহীরা স্বল্প সুদে ঋণ ও প্রশিক্ষণের দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যেগে সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ ও সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পের আওয়াতায় গ্রাম পর্যায় অর্থাৎ যেখানে নদী-খাল বা বিল আছে সেখানে ২০ জনের একটি দল গঠন করে ‘ভাঁসমান খাঁচায় মাছ চাষ’ করার উদ্বুদ্ধ করা হবে।

অর্থাৎ সারা দেশে নদী ও খাল-বিলকে যথাযথ ব্যবহার করে সরকার দেশে মৎস্য চাষে স্বংয় সম্পন্ন্ ভাবে গড়ে তোলার জন্যে সারাদেশে “ভাঁসমান খাঁচায় মাছ চাষ” প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত বছর জেলার মহাদেবপুর উপজেলার হাতুর ইউনিয়নের মহিষবাতান এলাকায় আত্রাই নদীতে ‘ভাঁসমান খাঁচায় মাছ চাষ’ প্রকল্প জেলায় প্রথমবারের মতো হাতে নেয়া হয় । এরপর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মাহফুজুল হক স্থানীয় ২০জন বেকারদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ।

মহাদেবপুর উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা একেএম জামান সিল্কসিটিনিউজকে জানান, মাছের চাষের জন্যে ২ লাখ টাকা সরকারি অনুদানও দেওয়া হয়। অনুদানের টাকায় ড্রাম, নেট ও বাঁশ দিয়ে মহিষবাথান খেয়াঘাট এলাকায় আত্রাই নদীর উপর ওই ১০টি খাঁচা তৈরি করেন। গত বছরের ৭ আগষ্ট মহিষবাতান এলাকায় আত্রাই নদীতে ১০টি খাঁচা স্থাপন করে ভাঁসমান খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করা হয়েছে। প্রতিটি খাঁচায় ৫শ’টি করে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের পোনা বগুড়ার আদমদিঘী থেকে এনে খাঁচায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে ।

বর্তমানে প্রতিটি তেলাপিয়া গড়ে সাড়ে ৪শ’ গ্রাম ওজন হয়েছে। এই পদ্ধিতে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই দলের সদস্যরা নিজেদের খরচে আরও ১০টি খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেছেন। মহিষবাথান সিবিজি (কমিউনিটি বেইসড গ্রুপ) দল নেতা টিক্কা জানান, তাদের ব্যক্তি উদ্যেগে চাষ করা মাছ দুটি খাঁচা থেকে গত কিছুদিন আগে ৭৫ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন তারা ।

স্থানীয় মাছ চাষি সূত্রে জানা যায়, উপজেলার মহিষবাথান এলাকা ও কুঞ্জবন এলাকায় আত্রাই নদীতে এখন ৭৬টি খাঁচায় মাছ চাষ করেছেন ৩৫ জন মাছ চাষি। মাছ চাষের নতুন এ পদ্ধতি দেখে স্থানীয় বেকার যুবকরা নিজস্ব উদ্যোগে নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করতে শুরু করেছেন।

মহিষবাথান গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন সিল্কসিটিনিউজকে জানান, তিনি মহিষবাথান মৎস্যজীবী সমিতির একজন সদস্য। তার কোনো জলাভূমি নেই । নদীতে মাছ ধরে ও মৌসুমের সময় অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারের খাঁচার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তি উদ্যেগে একই সাথে ১০টি খাঁচায় মাছ চাষ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। আরো ১০টি খাঁচা তৈরী করা হয়েছে মাছ চাষের জন্যে । শীত গেলেই মাছ চাষ শুরু করা হবে।

তাদের মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে একই এলাকার কুঞ্জবন গ্রামে নদীতে দুই বন্ধু মনজেল হোসেন ও বুলবুল আহমেদ আত্রাই নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করছেন। তারা দু’জন তিন মাস থেকে ২০টি খাঁচায় মাছ চাষ করছেন।

তারা জানান, জিআই পাইপ, নেট ও ড্রাম দিয়ে ২০টি খাঁচা তৈরি করতে তাদের খরচ পড়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাঁশ, নেট ও  ড্রাম দিয়ে পাঁচটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। হ্যাচারি থেকে পোনা এনে রাখার জন্য বাঁশ ও নেট দিয়ে একটি বড় হাঁফা (বড় খাঁচা) তৈরি করতে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা।

প্রতিটি খাঁচায় ১ হাজার থেকে ১২শ’ পিস করে ২০টি খাঁচায় প্রায় ২৫ হাজার পিস তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছেন। আর একটি খাঁচায় পরীক্ষামূলকভাবে পাঙ্গাস মাছ চাষ করছেন। মাছের পোনা ছাড়তে খরচ পড়েছে ১ লাখ টাকা।

এলাকার মনজেল হোসেন সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, ডিগ্রি পাশ করে বাড়িতে বেকার বসে ছিলাম। নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি দেখে আমি ও বুলবুল খাঁচায় মাছ চাষের সিদ্ধান্ত নিই। প্রশিক্ষণ নিয়ে এরপর চাঁদপুর জেলায় গিয়ে ভাঁসমান চাষের জন্যে জিআই পাইপ, নেট নিয়ে আসেন। গত বছরের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আত্রাই নদীতে খাঁচা তৈরী করে খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেন ।

মাত্র তিন মাসে প্রতিটি মাছের ওজন ৭শ’ থেকে ৮শ’ গ্রাম পর্যন্ত হয়েছে। মাছ চাষে সব মিলে তাদের সাড়ে ৫ লাখ টাকা খরচ হবে । আর ২০-২৫ দিন পর মাছ বিক্রি করা যাবে । আশা করছেন সব খরচ বাদ দিয়ে আড়াই লাখ টাকা লাভ থাকবে। আগামিতে আরো বেশি বড় পরিসরে মাছ চাষের কাজ হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

মহিষবাথান সিবিজি (কমিউনিটি বেইসড গ্রুপ) দল নেতা আবু তালেব সিল্কসিটিনিউজকে জানান, প্রথম বছরে একটি বেশি খরচ হয়েছে তারপরও মাছ চাষে সাফল্য দেখা দিয়েছে। আগামিতে এই খাঁচায় মাছ চাষ করা হলে অল্প খরচে বেশি লাভ করা যাবে। তাদের সাফল্য দেখে এলাকার অনেক বেকার যুবক, ব্যবসায়ী, মৎস্যজীবী আগ্রহী হয়ে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নিচ্ছেন।

উপজেলার উত্তর গ্রামের আব্দুর রশীদ সিল্কসিটিনিউজকে জানান, মাছ চাষের সাফল্য দেখে সিবিজ’র সদস্য ও মৎস্য কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে ইত্যে মধ্যে তাদের গ্রামে যুবকদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে । তাদের গ্রামের একটি বিল আছে সেখানে এই পদ্ধিতে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

মহিষবাথান সিবিজি (কমিউনিটি বেইসড গ্রুপ) দল নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, সরকারি উদ্যোগে আরও বেশি সংখ্যক চাষিকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলে এবং খাঁচায় মাছ চাষে উদ্যোগী বেকার যুবকদের স্বল্পমূল্যে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে এই পদ্ধতি আরও প্রসার লাভ করবে। এতে এলাকার বেকার যুবকরা স্বাবলম্বী হতে পারবে।

উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অজিত মন্ডল সিল্কসিটিনিউজকে জানান, জেলায় পুকুরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও চাহিদা মতো মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। যার কারণে বিশেষ করে খরা মৌসুমে অনেক বেশি দামে মাছ কিনতে হয়। তিনি আরো বলেন, জেলায় আত্রাই, পূর্ণভবা, ছোট যমুনা, নাগর, শিব, ফকিন্নি, তুলসী গঙ্গাসহ অনেক বিল আছে। এসব নদী-বিলে এই পদ্ধিতে মাছ চাষ করলে মাছের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে শতশত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে ।

মহাদেবপুর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মাহফুজুল হক সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, বেকার সমস্যা দূর ও ভূমিহীন মৎস্যজীবীদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশে জেলার মহাদেবপুরে এই প্রথম খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়েছে। আগামিতে উপজেলায় আরো বেশি করে এই পদ্ধিতে মাছ চাষ করার জন্যে সহযোগিতা করা হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান সিল্কসিটিনিউজকে জানান, নদী বা বিলে খাঁচায় এই পদ্ধিতে চাষ করলে রাসায়নিক খাবার মুক্ত মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। তাই বলা চলে শতভাগ এই মাছ নিরাপদ। তিনি আরো বলেন, ইত্যে মধ্যে মহাদেবপরের ওই এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে এই পদ্ধিতে মাছ চাষ। আগামিতে জেলার ১১টি উপজেলায় নদী ও বিলের আশেপাশে স্থানীয়দের ‘ভাঁসমান খাঁচায় মাছ চাষ’ করতে উদ্বুদ্ধ করাসহ সরকারি সহযোগিতা অব্যহত থাকবে।
স/আ