নতুন কৌশলে বাল্যবিয়ে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের চরসারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ে গত বছর শুরুর দিকে অষ্টম শ্রেণিতে ছাত্রী ছিল ৯ জন। সেই হিসাবে চলতি বছর নবম শ্রেণিতে ৯ জন ছাত্রী থাকার কথা, কিন্তু করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ শেষে চলতি মাসে স্কুল খোলার পর নবম শ্রেণিতে নার্গিস নাহার নামের একজন ছাত্রী পাওয়া গেছে। বাকি আটজন লেখাপড়া বাদ দিয়েছে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

একইভাবে গত দেড় বছরে সাতক্ষীরার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫০ জন ছাত্রীর বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফ জানান, বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকভাবে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির অন্তত ৫০ জন ছাত্রীর বিয়ের কথা জানা গেছে। এদের মধ্যে ১৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। বিষয়টি তদন্তে এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সাতক্ষীরার ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক, যিনি ভোমরা স্থলবন্দরে একটি সিঅ্যান্ডএফ অফিসের কর্মচারী। তিনি জানান, স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনায় মন বসত না মেয়ের। ছিল আর্থিক অনটনও। এ জন্য ভালো পাত্র পাওয়ায় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।

শুধু সাতক্ষীরা বা কুড়িগ্রামই নয়, দেশের অনেক এলাকায়ই গত দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকার সময় বিয়ে হয়ে গেছে অনেক স্কুলছাত্রীর। আইনে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এত বাল্যবিয়ে হচ্ছে—সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজি, আইনজীবী ও অভিভাবকরা মিলে নতুন কৌশলে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ‘বিবাহের ঘোষণাপত্র’ তৈরি করে দিচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু আইনজীবী। নিকাহ রেজিস্ট্রাররা বিয়ে নিবন্ধন করার সময় ছেলে-মেয়ের জন্ম নিবন্ধন, স্কুল বা কলেজের সনদসহ বিভিন্ন কিছু যাচাই করেন। কারো বয়স কম থাকলে তাঁরা বিয়ে নিবন্ধন করাতে আপত্তি জানান। যে কারণে অভিভাবকরা চলে যান আইনজীবীর কাছে। ভুয়া জন্মনিবন্ধন নিয়ে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ‘বিবাহের ঘোষণাপত্র’ নামের একটি লিখিত নথি তৈরি করেন। তারপর সেটিকে বিয়ে বলে চালিয়ে দেন।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় সম্প্রতি এমন ৯টি বাল্যবিয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ের ঘটনায় অভিভাবকদের জরিমানা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। দুই আইনজীবীকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়েছে।

পাইকগাছা থানার ওসি এজাজা শফী কালের কণ্ঠকে জানান, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন। এই বিয়ে দিতে নানাভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন। কথিত বিয়ের এমন ঘটনায় এক মা দুই আইনজীবীসহ সাতজনকে আসামি করে ১৪ আগস্ট পাইকগাছা থানায় মামলা করেছেন। ওই মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

স্থানীয়রা জানায়, গত মাসে উপজেলার ভিলেজ পাইকগাছা গ্রামের এক কিশোরীর সঙ্গে গোপালপুর গ্রামের এক তরুণের বিয়ের আয়োজন করছিলেন অভিভাবকরা। জন্মসনদ অনুযায়ী, মেয়েটির বয়স মাত্র ১২ বছর আট মাস, আর তরুণের বয়স ১৯ বছর। ১ আগস্ট নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ১০০ টাকার একটি স্ট্যাম্পে ‘বিবাহের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হয়। সেখানে তরুণের বয়স ২২ ও মেয়েটির বয়স ১৯ বছর দেখানো হয়। ওই স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেন পাইকগাছা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের আইনজীবী রেহানা পারভীন। এ ধরনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে।

‘কভিড-১৯ মহামারিকালীন বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি জরিপ পরিচালনা করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। ওই জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ২১টি জেলায় অন্তত ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫১২টি বাল্যবিয়ে হয়েছে বরগুনা জেলায়। এর ৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবারা তাঁদের আর্থিক অসচ্ছলতাকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। যাদের প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৬-১৭ বছর, ৪৮ শতাংশের বয়স ১৩-১৫ বছর এবং বাকি ২ শতাংশের বয়স ১০-১২ বছর বলে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ১০টি বাল্যবিয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষে। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ৫১ শতাংশ। যার মধ্যে প্রতি ১০ জনে পাঁচটি মেয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগেই এবং প্রতি ১০ জনে আটজন ২০ বছর হওয়ার আগেই মা হয়ে যায়।

ইউনিসেফের মতে, দরিদ্র মা-বাবা অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন, মেয়েরা চাকরি করতে পারবে না, শুধু ছেলেরাই পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে ধনী পরিবারের অনেকে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে তাদের সতীত্ব রক্ষা করছে। যৌন সহিংসতা থেকে রক্ষায় মা-বাবা বয়ঃসন্ধির শুরুতে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

করোনাকালে বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে ওপরের কারণগুলোর পাশাপাশি করোনাকালে পালিয়ে বিয়ের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বৈঠকে কমিটির পক্ষ থেকে বাল্যবিয়ের কারণ অনুসন্ধান ও তা বন্ধে করণীয় নির্ধারণে একটি জরিপ পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মহামারিতে অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে কম বয়সী মেয়েদের প্রেমের সম্পর্ক বেড়েছে। অল্প বয়সের অনেক মেয়ে এখন বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করছে। যার কারণে বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমরা এ জন্য জরিপ করতে বলেছি। জরিপ প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে সুপারিশ চূড়ান্ত করা হবে।’

এদিকে সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, শিশু একাডেমির মহাপরিচালক ও জাতীয় মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে পালিয়ে বিয়ে ও বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে জরিপ করার জন্য এর আগে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে গঠিত কমিটিগুলোকে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জরিপ পরিচালনার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বেসরকারি সংস্থা ‘টিম অ্যাসোসিয়েট’। সংস্থাটির টিম লিডার পুলক রাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে বাল্যবিয়ে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। শিক্ষা-চাকরিসহ যেকোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা যেন বৈষম্যের শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষদের সহজে আইনি প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।