নতুন কমিটিতেও সংঘটিত হতে পারছে না রাজশাহী আ.লীগ, হয়েছে নতুন কার্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

কমিটি গঠনের পরও সংগঠিত হতে পারছেন না রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। পদ না পাওয়া আর পদ পাওয়াদের কাতারে কারা ভিড়বেন এ নিয়ে এখনো চলছে রশি টানাটানি। বিশেষ করে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ গ্রুপকে নিয়ে এখনো বেশ লবিং-গ্রুপিং চলছে। আসাদুজ্জামান আসাদ গ্রুপকে কোণঠাসা করতে বা তাদেরকে কাছে টানতে চেষ্টা চালাচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা। তবে পদ বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে ফুঁসছেন আসাদ গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ কারণে তাঁরা এখনো ভেবে উঠতে পারছে না কোনা দিকে মোড় নিবেন। এই বিরোধ সবেচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে জেলার পুঠিয়া-দুগাপুর, তানোর-গোদাগাড়ী ও পবা-মোহনপুরে।

দলীয় সূত্র মতে, গত ৮ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের পর রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয় করা হয়েছে। নগরীর লক্ষীপুরে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের আগের কার্যালয়টি বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব পাওয়া নেতারা বসছেন নগরীর অলোকার মোড় এলাকায় অবস্থিত বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার ব্যক্তিগত কার্যালয়টিতে। আর আগের কার্যালয়টিতে এখন শুধু সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এবং তাঁর গ্রুপের নেতাকর্মীরা বসছেন। তবে একসময় যে কার্যালয়টি ছিলো নেতাকর্মীদের পদচারণায় সরগরম, এখন সেখানে অনেকটায় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে নেতাকর্মীদের সঙ্কটের কারণে। অন্যদিকে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা যে কার্যালয়টি গড়ে তুলেছেন সেখানে তাঁদের অনুসারীরা ভিড় করতে শুরু করেছেন।

প্রসঙ্গত, সম্মেলনের আগে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীই ছিলেন আসাদ গ্রুপে। আর একটি অংশ ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ওমর ফারুক চৌধূরীর দিকে। এই দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব গত কয়েক বছর ধরে এতোটাই প্রকাশ্যে আসে যে শেষের দিকে ফারুক-আসাদ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানা মন্তব্য করতে শুরু করেন। পাশাপাশি দুই গ্রুপের পক্ষ থেকেই কেন্দ্রে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ পড়তে থাকে। এমন হিমশিতল দ্বন্দ্বের জের ধরে শেষ পর্যন্ত তড়িঘড়ি করে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। গত ৮ ডিসেম্বর অনুষ্টিত হওয়া সেই সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত দু’জনকেই বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া হয়। এতে সভাপতি করা হয় সাবেক এমপি মেরাজ উদ্দিন মোল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় সাবেক এমপি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে। আর যুগ্ম-সম্পাদক করা হয় বর্তমান রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন ও বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলুকে।

দলীয় সূত্র মতে, এই কমিটি গঠনের পর একমাত্র রাজশাহী-৫ আসনের এমপি মুনসুর রহমান ছাড়া আওয়ামী লীগের অন্য চার এমপিরই নতুন কমিটির নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। যদিও সভাপতি মেরাজ উদ্দিন মোল্লা আসাদ গ্রুপের হলেও তিনি হঠাৎ করে সভাপতি হওয়ায় আসাদ সমর্থকরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই দেখছেন। আসাদকে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে সরাতে পেরে অনেকটাই ফুরফুরে অবস্থানে আছেন সাবেক সভাপতি রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধূরী। তানোর-গোদাগাড়ী থেকে ফারুক চৌধূরী বিরোধী যেসব নেতারা আসাদের গ্রুপে ভিড়েছিলেন আসাদ পদ না পাওয়ায় তাঁরা এখন অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বলে মনে করছেন ফারুক চৌধূরীর সর্মথকরা।

অন্যদিকে দলের একাধিক নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করার সূত্রে জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত সাবেক এমপি মেরাজ মোল্লার সঙ্গে একই আসনের বর্তমান এমপি আয়েনেরও দূরুত্ব ছিলো বেশ। এ কারণে মেরাজ মোল্লা বাধ্য হয়ে গত কয়েক বছর ধরে আসাদ গ্রুপে যোগ দিলেও এখন পদ পেয়ে নিজেই নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এমপি আয়েন জেলা যুগ্ম-সম্পাদক হওয়ায় তাঁর কর্মী-সমর্থকরাও রয়েছেন কিছুটা চাঙ্গা। যদিও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে এমপি আয়েন ছিলেন শক্ত প্রার্থী। কিন্তু তিনি ওই পদটি না পাওয়ায় এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি মেরাজ মোল্লা সভাপতি হওয়ায় অনেকটায় মনোক্ষুন্ন হন এমপি আয়েন উদ্দিন। কমিটি গঠনের দিন থেকে বেশ কয়েকদিন আয়েনের কর্মী-সমর্থকরা ফেসবুকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা মন্তব্যও করেন।

অপরদিকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি এনামুল হকের সঙ্গে আসাদের ভালো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি জেলার সব নেতাকর্মীদের মুখে-মুখেই ছিলো। কিন্তু আসাদ শেষ পর্যন্ত গত কাউন্সিলে কোনো পদ না পাওয়ায় এমপি এনামুল বিরোধ গ্রুপটি এখন অনেকটা চাঙ্গা। তাঁরা নতুন নেতাদের কাছে ছুটছেন বেশ জোরেসরে। তবে এমপি এনামুল গ্রুপের নেতাকর্মীরা কোনদিকে মোড় নিবেন, সেটি রয়েচে সংশয়।

এদিকে রাজশাহী-৫ আসনের বর্তমান এমপি মুনসুর রহমানের সঙ্গে আসাদের রয়েছে বেশ সখ্যতা। আবার মুনসুরের প্রতিদ্বন্দ্বি একই আসনের সাবেক এমপি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার সঙ্গে রয়েছে বিরোধ। ফলে গত কাউন্সিলের পর দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে পুঠিয়া ও দুর্গাপুরে কয়েকটি সংঘর্ষ পাল্টা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। জেলার সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়ে অনেকটা চাঙ্গা হয়েছে সাবেক এমপি দারার কর্মী-সমর্থকরা। তারা এখন পুঠিয়া-দুর্গাপুরের বিভিন্ন পদে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে পদ ঠেকাতে ও নেতাকর্মীদের কাছে টানতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মুনসুর। এ নিয়ে দুটি উপজেলার নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন চরম বিরোধ দেখা দিয়েছে। দারাকে ঠেকাতে মুনসুর এখনো পদ না পাওয়া আসাদের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। কিন্তু মুনসুরের কর্মী-সমর্থকরা এ নিয়ে রয়েছে দ্বিধায়।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজশাহী জেলার নয়টি উপজেলা ৭১টি ইউনিয়ন, ১৪টি পৌরসভার কোনোটিরই সম্মেলন এখনো হয়নি। এসব কমিটির সম্মেলনের আগেই জেলার সম্মেলন হয়ে যাওয়ায় মূলত আসাদ গ্রুপের কর্মী-সমর্থকরা রয়েছেন অনেকটা ব্যাকফুটে। তাঁরা নতুন কমিটির নেতাদের কাছে না ভিড়লে আগামীতে পদ হারাবেন বা বঞ্চিত হবেন এমন আশঙ্কায় রয়েছেন। আবার অনেকেই শত আশঙ্কার মধ্যেও ফারুক চৌধূরী ও দারাকে ঠেকাতে এখনো আসাদের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।’

তবে এসব নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমার কোনো গ্রুপ নাই। আমার কোনো লোকও নাই। তবে বিগত সময় যারা জেলা কমিটিতে ছিলেন, তাঁরা সকলেই দলের নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু বর্তমান কমিটি গঠনের পর নতুন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁরা হতাশ হয়েছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। কিন্তু এসব নেতাকর্মীদের যদি নতুন কমিটি দূরে রাখতে চায়, তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ আমার কোনো নিজস্ব লোক নাই। আমি যাদের নিয়ে চলেছি, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের লোক।’

তবে দলের মধ্যে যেটুকুর বিরোধ আছে, তা নিরসন করে আগামীতে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার চেষ্টা থাকবে বলে দাবি করেছেন জেলার সভাপতি মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে পদ পেতে লড়াই থাকবেই। তাই বলে কাউকে রেখে কাউকে নিয়ে চলাটা আমাদের ঠিক হবে না। আমরা সবাইকে নিয়ে চলতে চাই।’