ধর্ষণ মামলার ৫ প্রভাবশালী আসামি ধরা পড়েনি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: সূত্র: রাজধানীর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর ধর্ষকরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের কয়েকটি দল একাধিক স্থানে অভিযান চালালেও এখন পর্যন্ত প্রভাবশালী গ্রেফতার করতে পারেনি। এছাড়া ঘটনার পর ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা দায়ের করা ও হাসপাতালে গিয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা থেকেও বিরত রাখা হয়েছিল ধর্ষিতাদের।

থানা পুলিশও ধর্ষকদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে যাওয়ায় ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পর শনিবার বিকালে প্রভাবশালী এই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা নথিভুক্ত করে বনানী থানা। ধর্ষিতাদের ফরেনসিক পরীক্ষার পর চিকিৎসক জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন পার হয়ে যাওয়ায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া কঠিন হতে পারে। মামলা দায়ের ও ফরেনসিক পরীক্ষার পর প্রশ্ন উঠেছে, প্রভাবশালী ধর্ষকরা ধরা পড়বে তো?

ঘটনা তদন্তে সংশ্লিষ্টরা জানান, তরুণীদের ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। এ কারণে তারা জানত যে, কিছুটা বিলম্বিত করা গেলে ধর্ষণের আলামত মুছে যাবে। এছাড়া রেইনট্রি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজও এখন আর নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ। হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি, এক মাসের বেশি সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ করা হয় না।

ঘটনা ২৮ মার্চের হওয়ায় সেই সিসিটিভি ফুটেজ এখন আর নেই। কিন্তু ঘটনা তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। তারা বলেন, তদন্তের সময় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের ধরা গেলে ভিডিও ফুটেজও উদ্ধারও সম্ভব হতে পারে। তবে এর আগে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মামলা দায়েরের পর শনিবার রাতেই দুই তরুণীকে তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখান থেকে রবিবার দুপুরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরআগে তরুণীদের ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন ডা. মমতাজ আরা, ডা. নিলুফার ইয়াসমিন, ডা. কবিতা সাহা ও ডা. কবির সোহেল।

ধর্ষণের বিষয়ে ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘ভিকটিমদের মাইক্রোবায়োলজি, রেডিওলজিক্যাল ও ডিএনএ প্রোফাইলিং পরীক্ষার জন্য রাখা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন পেতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগতে পারে। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে ঘটনাটি বেশ কিছুদিন আগের হওয়ায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া কঠিন হবে।’

ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহার, পুলিশ ও ভিকটিমদের কাছ থেকে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী রাজধানীর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত ২৮ মার্চ পূর্বপরিচিত গুলশান-২ নম্বরের ৬২ নম্বর রোডের ২নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ও আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাদাত আহমেদ ও তার বন্ধু পিকাসো রেস্টুরেন্টের এক মালিকের ছেলে নাইম আশরাফ জন্মদিনের দাওয়াত দেয় তরুণীদের।

দাওয়াত দিয়ে গত ২৮ মার্চ সাফাত আহমেদ তার গাড়ি দিয়ে ড্রাইভার বিল্লাল ও বডিগার্ডের মাধ্যমে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে তাদের। তারা তরুণীদের জানায়, সেখানে অনেক লোক থাকবে। অনুষ্ঠানটি হবে হোটেলের ছাদে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর কোনও ভদ্র লোককে এই শিক্ষার্থীরা দেখতে পাননি। সাফাত, নাঈম ও সফিক ছাড়া সেখানে আরও দু’জন মেয়ে ছিল। তাদের ওই হোটেলে নিয়ে যাওয়ার পর আগে থেকে সেখানে থাকা অন্য দুই মেয়েকে সাফাত ও নাঈম বার বার নিচে নিয়ে যাচ্ছিল। সেখানকার পরিবেশ ভালো না লাগায় এই দুই তরুণী চলে যেতে যান। তখন তাদের গাড়ির চাবি নিয়ে যায় ধর্ষকরা।

তরুণীদের দায়ের করা মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, সাদমান সফিক তাদের পূর্ব পরিচিত। প্রায় দুই বছর থেকে তার সঙ্গে পরিচয় রয়েছে। ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে গুলশান-২ নম্বরের ৬২ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের।

শনিবার বিকালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে এক নম্বর আসামি হিসেবে সাফাত আহমেদ, নাইম আশরাফ, পিকাসো রেস্টুরেন্টের মালিক সাদমান সফিক, ড্রাইভার বিল্লাল, সাফাত আহমেদের বডিগার্ডের (অজ্ঞাত) নাম উল্লেখ করা হয়। এজাহারে বলা হয়, ২৮ মার্চ রাত ৯টায় ধর্ষকরা বনানীর কে ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাড়ির রেইনট্রি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় তাদের।

সেখানে পরদিন ২৯ মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত আটকে রাখে। এরপর তাদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মারধরসহ গালি দেয়।  একপর্যায়ে তাদের দুই জনকে একটি কক্ষে নিয়ে জোরপূর্বক নেশা জাতীয় মদ্যপান করানো হয়। সাফাত আহমেদ ও নাইম আশরাফ তাদের দু’জনকে একাধিকবার ধর্ষণ করে এবং ড্রাইভার বিল্লালকে দিয়ে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করে।

পরবর্তী সময়ে সাফাত তার দেহরক্ষীকে শিক্ষার্থীদের বাসায় পাঠিয়েছিল তথ্য সংগ্রহ করতে। এতে তারা আরও ভয় পেয়ে যান। ধর্ষকদের হুমকি ও লোকলজ্জার ভয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এই দুই শিক্ষার্থী। এ কারণে মামলা করতেও দেরি হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আব্দুল আহাদ বলেন, ‘ধর্ষণ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। তবে এখনও কোনও আসামি ধরা পড়েনি।’ রেইনট্রি হোটেলের ওই দিনকার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হোটেল কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ একমাসের ফুটেজ সংরক্ষণ করে থাকে বলে তাদের জানিয়েছেন। তাই ধর্ষণের ঘটনাসংশ্লিষ্ট কোনও ফুটেজ পাওয়া যায়নি।’

এদিকে এ ঘটনা তদন্তে রবিবার বিকালে গুলশান জোনের উপ-কমিশনারের কার্যালয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ধর্ষকরা যেন দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য অভিযুক্তদের পাসপোর্ট জব্দ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

রেইনট্রি হোটেলের এক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে বলেন,‘আমাদের একটা কক্ষ ভাড়া নিয়েছিল ধর্ষকদের ওই গ্রুপটি।’ এর বাইরে আর কোনও কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যা বলার পুলিশকেই বলব।’ বাংলা ট্রিবিউন