‘ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নাগরিক প্রতিরোধ সংগঠিত করতে হবে’

আজ রবিবার দুপুর ২টায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আফগান সংকট সম্পর্কে এক অনলাইন আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও মানবাধিকার নেতা শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের বিষয় ছিল: ‘আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতাদখল: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধের আহ্বান।’

সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, মিশর, ঘানা, লাইবেরিয়া, ইথিওপিয়া, সিয়েরা লিওন, মেসিডোনিয়া, রাশিয়া, পোল্যাণ্ড, ক্রোয়েশিয়া, সুইজারল্যাণ্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যাণ্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, জামাইকা, জাপান, আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়ার তিন শতাধিক শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আইনপ্রণেতা, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, শান্তিকর্মী ও উন্নয়নকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনের সূচনাপর্বে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আফগান মানবাধিকার নেত্রী বিশিষ্ট আইনজীবী কোবরা মোরাদি ছয় মহাদেশের ১০৭জন বিশিষ্ট নাগরিক কর্তৃক স্বাক্ষরিত খসড়া ঘোষণা ও প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা বিস্তারিত আলোচনার পর গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব জাতিসংঘ এবং এর সকল অঙ্গ সংস্থাকে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে তালেবান সহ সকল জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গিকার সম্মেলনে ব্যক্ত করা হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি মানবাধিকার নেত্রী তাহেরা আবদুল্লাহর প্রস্তাব অনুযায়ী সম্মেলনে গৃহীত ঐতিহাসিক প্রস্তাবের সপক্ষে বিশ্বব্যাপী ১০ লক্ষ গণস্বাক্ষর সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

kalerkantho

সম্মেলনে অন্যান্য বক্তা ছিলেন আফগান ইন্টেলেকচুয়ালস গ্লোবাল কমিউনিটি-এর প্রেসিডেন্ট মানবাধিকার নেতা ও লেখক শাহী সাদাত, বেলজিয়ামের সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরাম-এর নির্বাহী পরিচালক ও প্রাক্তন এমইপি পর্তুগিজ রাজনীতিবিদ পাওলো কাসাকা, ভারতের ডেইলি পাইওনিয়ার-এর উপদেষ্টা সম্পাদক লেখক সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার, যুক্তরাষ্ট্রের ইরানি নারী অধিকার কর্মী সাংবাদিক বানাফসে যানদ, সুইডেনের ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশন-এর মানবাধিকার নেত্রী এ্যাটর্নি মোনা স্ট্রিন্ডবার্গ, সুইস ইন্টার-স্ট্রাটেজি গ্রুপ-এর কম্যুনিকেশনস-এর ডিরেক্টর নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, পাকিস্তানের নারী অধিকার ও শান্তি কর্মী, “তেহরিক-ই-নিশওয়ান”-এর সভাপতি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী সীমা কেরমানি, তুরস্কের আর্থ সিভিলাইজেশন প্রজেক্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা, কবি ও নাট্যকার তারিক গুনারসেল, ফ্রান্সের খাইবার ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা, লেখক সাংবাদিক ফজল উর রহমান আফ্রিদি, যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেস-এর সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা ড. লাকুমাল লুহানা, তুরস্কের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ থিয়েটার ক্রিটিক-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিশিষ্ট লেখক ও নারী অধিকার নেত্রী জেনেপ ওরাল, ফোরাম ফর সেকুলার নেপাল-এর সভাপতি রাষ্ট্রদূত যুবনাথ লামসাল, ফোরাম ফর সেকুলার ইজিপ্ট এ্যান্ড মিডল ইস্ট-এর সভাপতি লেখক সাংবাদিক মহসিন আরিশি, আফ্রো-এশিয়ান পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশন-এর প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার নেতা আরিয়াদাসা বিদ্যাসেকেরা, ঘানার মানবাধিকার নেত্রী সাংবাদিক মারিয়াম ইয়াং, উজবেকিস্তানের উইঘুর মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিক সাবো কোসিমোভা, পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী তাহেরা আবদুল্লাহ প্রমুখ।

সভাপতির ভাষণে বাংলাদেশের লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার কবির সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের বিশিষ্টজনদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আফগানিস্তানে বৈধ সরকারকে অবৈধভাবে অপসারণ করে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসী তালেবানরা যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তার বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষ আজ সোচ্চার। আমরা অতীতে আফগানিস্তানে একই পন্থায় তালেবানদের ক্ষমতাদখল এবং পাঁচ বছরের নারকীয় শাসনকাল দেখেছি; যেখানে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতিসত্তা নির্বিশেষে আফগানদের উপর সীমাহীন দুর্যোগ নেমে এসেছিল। দক্ষিণ এশিয়া সহ গোটা পৃথিবীতে পাকিস্তান, আমেরিকা ও সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তালেবানরা গত তিন দশক ধরে যে ভাবে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাস রফতানি করেছে, তার মাশুল আজও আমাদের দিতে হচ্ছে। বিশেষভাবে মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে গত পঁচিশ বছরে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও তালেবানিকরণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের সাম্প্রতিক উত্থানে এসব দেশের মৌলবাদী ধর্মব্যবসায়ীদের উল্লাসে আমরা উদ্বিগ্ন। বিশ্বের সর্বত্র মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতে হলে এবং সভ্যতার বোধ ও বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে হলে দেশে দেশে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার নামে উগ্রতা, সন্ত্রাস ও হত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’

সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপনকালে আফগান-অস্ট্রেলিয়ান মানবাধিকার নেত্রী কোবরা মোরাদি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষত শান্তি এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। আফগানিস্তানে উদ্ভূত সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ সমগ্র আফগান জাতির ভবিষ্যৎ এবং ৩.৮ কোটি আফগান জনগণের জীবন-জীবিকাকে প্রভাবিত করবে। লিঙ্গ, বয়স, জাতি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক আফগানদের অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের সবকিছুই করতে হবে। তালেবানের একচেটিয়া শাসন ব্যবস্থা মানবাধিকার এবং আইনের শাসনকে সম্মান করে না। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তাদেরকে ধিক্কার জানানো এবং স্বীকৃতি না দেয়া।’

সম্মেলনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে আফগানিস্তানের ভুক্তভোগী মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য মানবাধিকার নেতা পাওলো কাসাকা বলেন, ‘যারা সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের সবাইকে অবশ্যই আফগান জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে এবং যারা দেশটিকে তালেবানের হাতে তুলে দিতে চায় তাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করতে হবে। ধর্মান্ধ তালেবান শাসকরা তাদের দেশের জনগণের জন্য তো বটেই সমগ্র বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ভারতের ডেইলি পাইওনিয়ার-এর উপদেষ্টা সম্পাদক লেখক সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার বলেন, ‘ইতোপূর্বে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের শাসনের ভয়াবহতা এখনো আফগানিস্তানের জনগণকে তাড়া করে, বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনতা হরণ, ধর্মীয় পুলিশের মাধ্যমে প্রত্যেক পুরুষের দাড়ি-টুপি, টাখনুর উপরে কাপড় পরেছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিশ্চিত করা আফগানদের জন্য এখনও দুঃস্বপ্নের মতো। যদিও তালেবান বলছে এখন তারা আগের অবস্থানে নেই, তারা নারীদের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছে। তাদের এই কথার কোন ভিত্তি নেই এবং তাদের কোনভাবেই বিশ্বাস করা উচিত হবে না।’

ইরানী নারী অধিকার কর্মী সাংবাদিক বানাফসে যানদ বলেন, ‘আমি ইরানের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানের নারী ও সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলতে চাই। আমরা চাই, আফগানিস্থানে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক যেখানে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। নারী অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে ধর্ম-বর্ণ ও জাতিগোষ্ঠী সকলের স্বাধীনতা কেবলমাত্র গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যেই নিহিত- যা থেকে তালেবানরা যোজন যোজন দূরে। সুতরাং একবিংশ শতাব্দীতে তালেবান যেন আফগানিস্থানে মধ্যযুগীয় বর্বর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারে এ ব্যাপারে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

ব্রিটিশ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা এবং ন্যাটো চলে যাবার পর ভারতকে নতুন একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। যখন নিরাশাবাদীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের দিকে চেয়ে ছিল তখন পাকিস্তান আফগানিস্তানের জঙ্গিবাদের তত্ত্বাবধায়ক হয়ে ওঠে। পাকিস্তান তখন তাদের মৌলবাদী জঙ্গিদের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান সর্বদা প্রতিরক্ষার পরিবর্তে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। এতকিছুর পর তালেবান এবং পাকিস্তান জঙ্গিবাদ ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এমনটা চিন্তা করা বোকামী ছাড়া কিছুই হতে পারে না।’

পাকিস্তানের নারী অধিকার কর্মী ও “তেহরিক-ই-নিশওয়ান’ -এর সভাপতি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী সীমা কেরমানি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের নারীরা আফগানিস্তানের নারী এবং নির্যাতিত মানুষের পাশে থেকে সামরিকতন্ত্র, মৌলবাদ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব। আফগানিস্তানের নারীরা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই মুক্ত নই। আমরা বিশ্বাস করি, আফগানিস্তানের নারীদের অবশ্যই শিক্ষা, ভ্রমণ, চলাচলের স্বাধীনতা, চাকরি, নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ সমস্ত অধিকার থাকতে হবে। একই সাথে আমি শিল্পী, রূপান্তরকামী, এলজিবিটি সম্প্রদায় এবং হুমকির সম্মুখীন সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। আমারা এই অধিকারগুলির সুরক্ষা কবজ হিসেবে সমতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিগুলি সমর্থন করি।’

প্রখ্যাত পশতুন বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী ফজল উর রহমান আফ্রিদি বলেন, ‘তালেবানের কাবুল দখল আফগানিস্তান ও সমগ্র অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী করেছে। তাদের এই কর্তৃত্বের ফলে দেশটির উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে শত্রুতা তৈরী হবে। হুমকির সম্মুখীন হবে তাজিক, উজবেক এবং হাজারা জনগোষ্ঠী। ফলে অচিরেই দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, মায়ানমার, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন এবং ভারতে আইএস, তালেবানের মত জঙ্গীগোষ্ঠীর কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে।’

তুরস্কের বিখ্যাত লেখিকা ও মানবাধিকার কর্মী জেনেপ ওরাল বলেন, ‘১৯৮০ সালের পর থেকে আমেরিকা তালেবানকে সহযোগিতা করেছে। তারা ন্যাটোর মাধ্যমে ২০ বছর ধরে সেখানে অভিযান চালিয়েও শান্তি এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারেনি। আফগান নারীদের অধিকার এবং স্বাধীনতা আজ হুমকির মুখে। আফগানিস্তানের রাস্তাঘাটে রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়ার আগেই সারা বিশ্বের উচিৎ তালেবানের উপর চাপ প্রয়োগ করা।’

ফোরাম ফর সেকুলার নেপাল-এর সভাপতি রাষ্ট্রদূত যুবনাথ লামসাল বলেন, ‘আফগানিস্তানে তালেবানের কর্তৃত্ব গ্রহণের ফলে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ক্ষুণ্ন হয়েছে যা আমাদের সবার জন্য বেশ উদ্বেগের। আমরা বিশ্বাস করি, আফগানিস্তানের জনগনকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের সরকার বেছে নেয়ার অধিকার রয়েছে।’

উজবেকিস্তানের উইঘুর মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিক সাবো কোসিমোভা বলেন, ‘ইতোপূর্বে তালেবান যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছিল তখন তারা আফগানিস্তানের জনগণ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে এমন বার্তা দিয়েছিল যে, তারা খুব সাধারণ ভাবেই আফগানিস্তানের শাসনকার্য পরিচালনা করবে কিন্তু কিছুদিন পরেই তাদের সীমাহীন বর্বরতার চিত্র বিশ্ব সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ করেছিল। ঠিক একই কায়দায় তারা আফগানিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করতে চলেছে। তারা আফগানিস্থানে পুনরায় শরিয়া আইন প্রবর্তন করবে- এই ঘোষণা ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে কমিউনিস্ট চীন, যারা নিজেদের দেশে উইঘুর মুসলমানদের নির্যাতন করছে মুসলমান হওয়ার কারণে, তারা আফগানি জঙ্গি সন্ত্রাসী তালেবানদের সমর্থন করছে। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান গোটা বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। সুতরাং তালেবানের ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়-
যেহেতু, আফগানিস্তান বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, মতাদর্শ এবং ভৌগলিক বৈচিত্রসহ বহু জাতি গোষ্ঠীর একটি দেশ;
যেহেতু, আফগানিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সাংবিধানিক সরকার এবং জাতীয় পতাকা গ্রহণের অধিকার রয়েছে;
যেহেতু, আফগানিস্তানের জনগণের রয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং অন্য সকল অধিকার- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, জাতিসংঘের কনভেনশন ও আইন, ইউডিএইচআর এবং জাতিসংঘ সনদ দ্বারা সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত;
যেহেতু, আফগান নারীরা দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেক, জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে আফগান নারীদের সমতা, ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের মৌলিক মানবিক অধিকার রয়েছে, বিশেষত আসন্ন শান্তি ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে;
যেহেতু, চরমপন্থী জঙ্গি তালেবান জোরপূর্বক আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করেছে;
যেহেতু, তালেবান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে তাদের নতুন “মধ্যপন্থী অবস্থান” প্রচার করলেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অসম্মান, নারী ও সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার, আইনের শাসন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিশ্চিত মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়ে তাদের চরমপন্থী ধর্মতাত্ত্বিক মতাদর্শকে পরিত্যাগ করেনি;
যেহেতু, জাতিসংঘ এবং এর অনেক সদস্যরাষ্ট্র তালেবানকে তার জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং চরমপন্থী মতাদর্শের জন্য একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, পাশাপাশি তালেবানরা দেশে-বিদেশে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে;
যেহেতু, দখলদার তালেবান-এর জঙ্গি সদস্যরা এখনও আফগানিস্তানে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করছে;
যেহেতু, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী তালেবান-এর দখলদার জঙ্গিরা ইতোমধ্যে তাদের নেতাদের অবৈধভাবে সরকারের মন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা আরম্ভ করেছে; উপরন্তু তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, নারীদের সরকারের  ঊর্ধ্বতন কোন পদে সমাসীন করবে না, তবে ‘নারী স্বাস্থ্য’ এবং ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ পরিষেবা খাতে নারীদের নিয়োগের জন্য ‘অনুমতি’ দেয়া হবে;
যেহেতু, তালেবানরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারের কথা বাদ দিয়েছে, এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী তালেবান জঙ্গিদের অধীনে আফগান শিয়া, হাজারা ও অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন;
সেহেতু, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে আফগান সংকট বিষয়ক এই আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ছয়টি মহাদেশের আইন প্রণেতা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী, শান্তি কর্মী, সংখ্যালঘু অধিকার কর্মী, সুশীল সমাজ, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যম কর্মী এবং আফগান প্রবাসীরা নিম্নলিখিত দাবিগুলিকে অনুমোদন ও সমর্থন করেন।

সম্মেলনে যেসব প্রস্তাব অনুমোদিত হয়-

১.    জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এবং জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী চরমপন্থী জঙ্গি তালেবান (টিটিএ) গোষ্ঠীর অসাংবিধানিক ও অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দ্ব্যর্থহীন নিন্দা জানানোর জন্য একটি প্রস্তাব পেশ এবং সমর্থন করতে হবে। অতঃপর জাতিসংঘের কোন সদস্য রাষ্ট্রের স্বঘোষিত তালেবান “সরকার” বা “আফগানিস্তান ইসলামিক আমিরাত”কে স্বীকৃতি দেওয়া অবশ্যই অনুচিত- কারণ তা হবে অবৈধ, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক।
২.    জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এবং জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই সুবিস্তৃত, সর্ব-অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে, এরপর আফগান জনগণের  জন্য আইনগত এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত ও বৈধ প্রতিনিধিত্বের বিধান করতে হবে- যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অ-ধর্মতান্ত্রিক সরকার গঠন, অঞ্চল, জাতি, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, সম্প্রদায়, বর্ণ, গোত্র, উপজাতি, শ্রেণী নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের সমান অধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; এবং আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের বিদ্যমান পতাকার প্রতি দায়বদ্ধ।
৩.    আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে অবশ্যই ঘোষণা করতে হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে- এখন থেকে তাদের ভূখণ্ড বা সীমান্ত কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন/গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেবে না এবং জঙ্গিবাদ প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হবে না।
৪.    আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলির সরকারের উচিত হবে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য তাদের সীমানা উন্মুক্ত করা।
৫.    অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো বিশেষত: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ন্যাটো জোট এবং গত ২০ বছরে আফগানিস্তান দখলে সামরিকভাবে জড়িত বৃহত্তর জোটকে আফগানিস্তানে বর্তমান মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রদান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৬.    এই দেশগুলোকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দেয়া আরম্ভ করতে হবে: (ক) আফগান শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা; (খ) আফগানিস্তানে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা, বিশেষত আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস্তুচ্যুত আফগানদের ত্রাণ প্রদানকারী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজ, সংস্থা/এনজিওগুলিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা; (গ) প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোকে (বিশেষ করে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএফপি, ইউএনওসিএইচএ) জরুরী অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান; এবং (ঘ) পরবর্তীতে আফগানিস্তানে বারবার আক্রমণ, দখল এবং ক্রমাগত যুদ্ধের ৪২ বছর পর প্রয়োজনীয় ব্যাপক পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন শুরু করার জন্য উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করা।
৭.    জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজকে স্বল্প-মধ্যমেয়াদে আফগানিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা উচিত নয়, কারণ আন্তর্জাতিক উপস্থিতি (ক) মানবিক ত্রাণ প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ;  (খ) আলোচনাকৃত শান্তি ও মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার পর্যবেক্ষণ ও সুরক্ষার বিষয়ে লক্ষ্য রাখা;  এবং (গ) পুনর্গঠন কর্মসূচী শুরুতে সমর্থন করা।
৮.    জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএন-এইচআরসি) মাধ্যমে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়কে আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়নের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত প্রমাণ পর্যবেক্ষণ, নথিভুক্তি, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য জরুরিভিত্তিতে একটি স্বাধীন তথ্যানুসন্ধান কমিশন গঠন করতে হবে।
৯.    আফগান সমাজের সকল দুর্বল অংশ বিশেষত নারী, কন্যাশিশু, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং আফগানিস্তানের সকল ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে; পাশাপাশি তাদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করতে হবে।
১০.    সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ সহ জাতিসংঘকে এর সকল সনদের অধীনে প্রদত্ত আফগান গণমাধ্যমে (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের) মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তাসহ প্রচার-প্রসার নিশ্চিত করতে হবে।
১১.    আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর উচিত সকল প্রকার গণহত্যামূলক অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাদের কাজ এগিয়ে নেয়া, বিশেষ করে যুদ্ধ/গৃহযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে নারী ধর্ষণ, দাসত্ব এবং জোরপূর্বক বিবাহকে ব্যবহার করা, হোক তা আফগানিস্তানে বা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে; এবং যে রাষ্ট্রগুলি এই জাতীয় অপরাধ করে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
১২.    আমরা নিন্দা ও প্রত্যাখ্যান করি এবং আমরা সকল রাষ্ট্রকে ঊনবিংশ শতাব্দীর সনাতন সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিক ও সামরিক ধারণা এবং চরমপন্থী সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে “সামরিক সম্পদ” হিসাবে ব্যবহার করা, অথবা অভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তথাকথিত “ভাল” বনাম “খারাপ” পার্থক্য করা, বিভাজন এবং শাসনমূলক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলা বন্ধের জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে আহ্বান জানাই। আফগানিস্তানের পাশাপাশি মধ্য ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ন্যায়বিচারের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এসব এখনই বন্ধ করতে হবে।