ধন্য সেই পুরুষ

তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, এমন এক রাজনীতিক যিনি সর্বতোভাবে দেশপ্রেমিক ছিলেন। প্রত্যহ, জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত স্বদেশ ও দেশবাসীর প্রতি আত্মনিবেদনে উন্মুখ ও অবিচল এই মানুষটি বারবার প্রায় মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলেছেন, আমার দেশের জনসাধারণকে আমি ভালোবাসি, তারাও ভালোবাসে আমাকে। এই বাক্য উচ্চারণের সময় যেন গর্বে স্ফীত হতো তাঁর বুক। শেখ মুজিব রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার এক সাধারণ পরিবারে। ছেলেবেলা থেকেই সম্পর্কিত হন সেসব মানুষের সঙ্গে যারা কাজ করে মাঠে, জাল ফেলে নদীতে, দাঁড় বায়, গুন টানে ধনুকের মতো পিঠ বাঁকিয়ে, গরুরগাড়ি চালায় এবড়ো-খেবড়ো পথে। যৌবনে বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে শহরে আসেন। প্রথম থেকেই তাঁর চরিত্রে ছিল নেতৃত্বের উপাদান; এর ফলে পরিণত হন বিশিষ্ট ছাত্রনেতায়, অল্প সময়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন জাতীয় নেতৃবর্গের।

পাকিস্তানের প্রাসাদকেন্দ্রিক, সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পাশাপাশি আরও দুটি ধারা প্রবাহিত ছিল-প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক এবং উঠতি বুর্জোয়াভিত্তিক ধারা। বঙ্গবন্ধু মূলত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছিলেন। বলা যেতে পারে বেশ কিছুটা প্রভাবিত ছিলেন শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের দ্বারা। মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর সংস্পর্শে এসে তিনি মেহনতী মানুষের স্বার্থকে বড় করে দেখার শিক্ষা পেলেন। গণমানুষের প্রতি শেখ মুজিবের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও তাঁর অবিচল রাজনৈতিক নিষ্ঠা লক্ষ করে মজলুম নেতা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। যদিও শেষের দিকে দুজনের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে দুদিকে। কিন্তু শেখ মুজিব কখনো বর্ষীয়ান নেতার প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি। নিজস্ব ধরনে স্বদলীয় রাজনীতি করেছেন। দুজনের মধ্যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও শেষের দিকে দুজন হয়ে পড়েছিলেন একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন। এর কারণ আরও কারও কারও মতো আমারও অজানা।

আমি কোনো রাজনীতিবিদ নই। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নই। আমার সম্পর্ক সাহিত্য জগতের সঙ্গে। নিজেকে এ দেশের নগণ্য লেখক মনে করি এবং সমাজ সচেতন নাগরিক এবং সাংবাদিক হিসেবে মাঝে মাঝে রাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে লেখালেখি করি। আমার লেখার সারবত্তা সম্পর্কে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু আমি নিজের মনকে চোখ ঠারতে বরাবরই নারাজ। আমার বোধশক্তিতে ঘাটতি থাকতেই পারে কিন্তু আমি কোনো ছল-চাতুরির আশ্রয় নিই না। যা বিশ্বাস করি তা অকপটে বলি এবং লিখি। শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়ন করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। তবু তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরবার চেষ্টা করব।

 

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শ্রম ও নিষ্ঠার ফলে একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে জনগণমন অধিনায়কে পরিণত হন, এ কথা আমরা সবাই জানি। তাঁর এই সাফল্যের উৎস দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা। প্রধানত তাঁর উদ্যোগে ও উদ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক আন্দোলনকে বলীয়ান করেছে যদিও বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকেই। শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে প্রচুর নির্যাতন সহ্য করেছেন, বারবার নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারে। নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘকাল কারাগারে বন্দী ছিলেন। হিসাব করলে দেখা যাবে শেখ মুজিবের কারাবাসের মেয়াদ তার চাইতে খুব বেশি কম হবে না। মনে-প্রাণে বাঙালি এই জননেতা জেল-জুলুম সয়েছেন, বহু ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের কাছে মাথানত করেননি। আইয়ুব খানের প্রতি মওলানা ভাসানীর মতো নেতাও দুর্বল ছিলেন, কিন্তু মুজিব ছিলেন অনড়, অটল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়িয়ে ফাঁসিতে লটকানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। জনগণ জেলের তালা ভেঙে বের করে নিয়ে এলেন তাদের প্রিয় নেতাকে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরই শেখ মুজিব শুরু করলেন ৬ দফা আন্দোলন। এই ৬ দফাকে অনেকে ম্যাগনাকার্টা আখ্যা দিয়েছেন। স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম অসীম সাহসিক, দেশের মাটির কাছে পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ এই জননেতাকে পৌঁছে দিল লোকপ্রিয়তার শীর্ষে; বহু বর্ষীয়ান নেতার জনপ্রিয়তা ম্লান হয়ে গেল তার লোকপ্রিয়তার কাছে। এতে কেউ কেউ ঈর্ষান্বিতও হয়েছিলেন। মুজিব এগিয়ে গেছেন দৃঢ় পদক্ষেপে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম তার সীমা অতিক্রম করে গেল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সারা বাঙালি জাতি মুগ্ধ হয়ে শুনল শেখ মুজিবের সেদিনের সেই অসাধারণ ভাষণ, যা আজও আমাদের আন্দোলিত করে। বস্তুত সেদিনই ঘোষিত হলো আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের যে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন তার নজির খুব বেশি নয়। পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের কোনো কর্তৃত্ব এই ভূখন্ডে ছিল না।

শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু সে জন্য তেমন প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। এ কথা বলতেই হবে। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই বীর বাঙালি ‘জয় বাংলা’ আওয়াজ তুলে অস্ত্র ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে, হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা শুরু হওয়া গণহত্যার পর। শেখ মুজিব বন্দী হলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। নয় মাস তিনি বন্দী হয়ে থাকলেন পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলল তাঁরই নেতৃত্বে, প্রেরণার উৎস হয়ে থাকলেন অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। মজার ব্যাপার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে মহিমা কীর্তনে এতই মশগুল যে, একাত্তরে মেজর জিয়ার ঘোষণার ফলেই যেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু একাত্তরের সাতাশে মার্চে কে চিনত মেজর জিয়াকে? সেই ঘোষণার আগে কেউ যার নাম শোনেনি তার ডাকে সবাই লড়াই শুরু করে দেবে, এ রকম মনে করা বাতুলতারই নামান্তর। কেননা, সেই বেতার ঘোষণায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বের কথা উচ্চারিত হয়েছিল খোদ মেজর জিয়ারই কণ্ঠে বেশ কয়েকবার। অবশ্য পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নাম মুছে ফেলা হয় নির্লজ্জভাবে। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের স্থপতির নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে, সরকারনিয়ন্ত্রিত রেডিও-টেলিভিশন থেকে মুছে ফেলার এক নিরন্তর অপচেষ্টা করে আসছে। নতুন প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শেখানো হচ্ছে ছলেবলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাল ধরলেন। তখন দেশে নানা সমস্যা সঙ্গীন উঁচিয়ে রয়েছে। ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠালেন তিনি। অন্য কেউ এত সহজে এই সমস্যার সুরাহা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি হয়তো কিছু কিছু ভুল করে বসলেন; একাত্তরের দালাল ও ঘাতকদের বিনা বিচারে ক্ষমা করে দিলেন। শোনা যায়, যেসব দালালকে সাময়িকভাবে আটক করা হয় তাদের কারও জন্য তিনি জেলখানায় খাবার পাঠাতেন। একজন সাংবাদিক মুজিবকে এই ভুলের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি জবাব দেন, ‘তোমরাই তো আমার এই সর্বনাশ করেছ। কেন আমাকে জাতির পিতা বানাইলা? পিতা তো ক্ষমা করবেই।’ চরমপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুল তার ‘মুজিবের রক্ত লাল’ গ্রন্থে লিখেছেন। তিনি আরও লিখেছেন, মুজিব একবার তাঁকে এবং বিশিষ্ট প্রবাসী সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা বলেন তো আমার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কী কী দোষ আছে?’ আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ‘অভয় দিলে বলতে পারি, আপনি শেরেবাংলা ফজলুল হকের মতো মাদার্স হার্ট-মানে কি না মায়ের ক্ষমাসুন্দর হৃদয় নিয়ে দেশ শাসন করেছেন, তাই সমস্যা অনেক বেশি মনে হচ্ছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাবার সময় আপনার হৃদয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো নির্দয় হলে এতদিনে অনেক এগুতে পারতেন।’

বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যারাক থেকে ব্যাটন ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেননি রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পদে। আমলার গদি ছেড়ে চেপে বসেননি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কোনো আসনে। তিনি ছিলেন এ দেশের মাটি থেকে উড়ে আসা এক প্রতিভাবান সন্তান, প্রকৃতপক্ষে মাটির মানুষ, জনসাধারণের একান্ত আপনজন। অনেকে একজন প্রশাসক হিসেবে তাঁর দুর্বলতার কথা বলেছেন। কিন্তু সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি মুজিবভক্ত হিসেবে পরিচিত নন, বরং আওয়ামী লীগের শাসনামলের একজন কঠোর সমালোচক, তবে তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কখনো কোনো অশালীন মন্তব্য করেছেন বলে জানা নেই। তিনি জাতীয় সংসদেও শহীদ মুজিবের তারিফ করেছেন। যা হোক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর ইংরেজি গ্রন্থে লিখেছেন, যদিও শেখ মুজিবকে প্রায়ই তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং উপলব্ধি ক্ষমতার অভাবের জন্য সমালোচনা করা হয়, কিন্তু তিনি প্রখর সহজাত বুদ্ধি এবং রাজনৈতিক সচেতনতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর মানবিক গুণাবলী, তাঁর দয়া এবং ঔদার্য কোনো কোনো সময় মাত্রাতিরিক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। তাঁর মধ্যে বাঙালির সব ধরনের বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল।… প্রশাসক হিসেবে তিনি ব্যর্থ হয়ে থাকতে পারেন, তবে তাঁর নিজের কারণে নয়। পক্ষান্তরে, তাঁর দলের লোকদের লোভ, অযোগ্যতা ও শ্রেণি চরিত্রের কারণে। আর ছিল নয় মাস যুদ্ধের ফলে সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অবস্থা।

জনাব মওদুদ আহমদের মন্তব্যে ভক্তিবাদের কুয়াশা নেই, সত্যের স্বাক্ষর আছে। তিনি বাকশালকে কোনো ভ্রান্ত নীতি মনে করেননি। তার মতে বাকশালের স্বপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। তবে শেখ মুজিব ভুল সময়ে বাকশাল প্রবর্তন করেন। আমি নিজেও মনে করি, ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা সুবিবেচনা প্রসূত নয়। গোড়ার দিকেই এমন একটি ব্যবস্থা নিলে ভালো হতো। শেখ মুজিব গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু সমাজতন্ত্রে কি তিনি প্রকৃত সমর্পিত ছিলেন? এই প্রশ্ন আমার মনে আজও নাড়াচাড়া করে। তিনি তো মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়া শক্তির বিকাশের পক্ষপাতি ছিলেন বলে আমার ধারণা। যদিও কৃষক-মজুরের জন্য তাঁর প্রাণের টান ছিল অকৃত্রিম। যাই হোক, ১৯৭২ সালের নন্দিত সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম ছিল সমাজতন্ত্র। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি না থাকলে এটি নিশ্চয়ই সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত না। সারা জীবন গণতন্ত্রের সাধক হয়ে তিনি নিজে ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তাঁর চরিত্রবিরোধী কাজ। কিন্তু কেন? হয়তো তিনি জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের অনুসরণে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এতে তার জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে, আসবে স্বয়ংনিতা।

খন্দকার মোশতাক আহমেদের সময় থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের পাকিস্তায়ন প্রক্রিয়া বেশ সুপরিকল্পিতভাবে। যারা শেখ মুজিবকে হত্যা করে তারা শুধু দালালই নয়, মানসিকভাবে পাক্কা পাকিস্তানি। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ওঝা সেজে পাকিস্তানি ভূত তাড়ানোর চেষ্টা তো করলেনই না বরং সেই ভূতটি যাতে এ দেশের বাসিন্দাদের কাঁধে আয়েশে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে পারে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, পাকিস্তান মনোভাবাপন্ন লোকজনের মন্ত্রিসভায় সম্মানিত আসন দিয়ে। তিনি সংবিধান থেকে নির্বাসিত করলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের অঙ্গীভূত করে শেখ মুজিব ও তার পরিবারবর্গের এবং কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের চার নেতা হত্যাকারীদের বিচার নিষিদ্ধ করে দিলেন। এর নজির কোনো সভ্য দেশে নেই।

শেখ মুজিবকে নাকি দেশের মঙ্গলের জন্য হত্যা করা হয়। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু কিংবা নববধূকে কেন হত্যা করা হয়? তারা তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। মুজিবকে হত্যা করে দেশের যে কী আহামরি শ্রীবৃদ্ধি এবং মঙ্গল হয়েছে সে তো আমরা গত ১৬ বছর ধরে দেখে আসছি। যারা শেখ মুজিবের মতো বড় মাপের মানুষ, সিংহ হৃদয় দেশপ্রেমিক এবং সেই রাষ্ট্রের স্থপতিকে খুন করতে পারে আর যারা এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে তারা যে কোন স্তরের জীব তা সহজেই অনুমেয়। শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান অন্নদাশংকর রায়ের একটি কবিতা মনে পড়েছে। কবিতাটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের স্মরণে’

নরহত্যা মহাপাপ, তারচেয়ে পাপ আরও বড়ো

করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন

জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরই নিধন

নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর

সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের

যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করো অপরাধ ক্ষমা

কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা

একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের

রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত

পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা

পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা

ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোনিত

বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো না নীরব দর্শক

ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।

আবার জনাব মওদুদের মুজিববিষয়ক বইটির পাতা ওল্টানো যাক। তিনি লিখেছেন, মনে হয় শেখ মুজিব একটি অমরতার পাদপীঠ থেকে ফিরে আসেন শুধু তার দেশের সংগ্রামলব্ধ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মৃত্যুবরণ করতে। এই বাক্যটি বোঝাতে চেষ্টা করেছে, আহা শেখ মুজিবের ভাগ্যে আখেরে অমরত্ব জুটল না। জ্বী না। জ্বী না ব্যারিস্টার মওদুদ, আপনার এ কথা মেনে নিতে পারি না। পাকিস্তানি জান্তার হাতে নিহত হলেই মুজিব অমর হতেন আর এখন তিনি অমরতার পাদপীঠ থেকে অনেক দূরে; এ কথা আপনার মতো সুতার্কিক আইনজীবীর মুখ থেকে নিঃসৃত হলেও তাতে আমার মতো সামান্য বুদ্ধির ব্যক্তি সায় দিতে নারাজ। যেন সর্বকালের বাঙালিদের ধন্য পুরুষদের একজন, যিনি না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এত বিকশিত হতো না। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হতো না, তিনি অমর হবেন না তো কে হবেন? তাঁর দোষ-ত্রুটি এবং রাজনৈতিক ভ্রান্তি সত্ত্বেও তিনি অমরদের একজন। যতদিন বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি এবং সংস্কৃতি টিকে থাকবে ততদিন এ দেশের মানুষের চেতনায় অমর হয়ে থাকবেন ধন্য সেই পুরুষ। বাংলা মায়ের মহান সন্তান।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন