দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা আরও বাড়বে

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯ শনাক্তের) সংক্রমণের তৃতীয় মাসে গিয়ে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি শুরু হয়েছে। এই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যু, সংক্রমণ শনাক্তের হার—সবই দ্রুত বেড়েছে। আক্রান্তের শীর্ষ ২০ দেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ সময়ে। এ অবস্থায় আজ সোমবার দেশে কোভিড-১৯ শনাক্তের তিন মাস পূর্ণ হচ্ছে।

আক্রান্তের শীর্ষ ২০-এ থাকা বেশির ভাগ দেশেই চতুর্থ মাসেও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। কোনো কোনো দেশে পঞ্চম মাসেও সেটা অব্যাহত আছে। ইউরোপের তুলনায় এশিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি বেশি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। যদিও উন্নত দেশগুলোতে রোগী শনাক্তের পরীক্ষা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (রোগীর সংস্পর্শে কারা এসেছিল) ও লকডাউন ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভালো।

ওই দেশগুলোর অভিজ্ঞতা এবং দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সংক্রমণ চিত্র থেকে বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে চতুর্থ মাসেও দেশে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা আছে। চলতি সপ্তাহের শেষ দিক থেকে এর ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। এখনই কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে অন্তত আরও এক মাস সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে কোভিড-১৯ শনাক্তের কথা জানানো হয়। তাঁদের দুজন ছিলেন ইতালিফেরত। অন্যজন আক্রান্ত এক ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন। এখন পর্যন্ত অন্তত ৮টি দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশে এই ভাইরাস ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুরুতে বিদেশফেরত ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণ সীমিত থাকলেও পরে সেটা ব্যাপক আকার ধারণ করে। গতকাল রোববার পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ৬৫ হাজার ৭৬৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮৮৮ জন, সুস্থ হয়েছেন ১৩ হাজার ৯০৩ জন।

সংক্রমণের তৃতীয় মাসের শেষে এসে দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে এক দিনে সর্বোচ্চ ৪০ জন মৃত্যুর তথ্য ছিল।

গতকাল সোমবার সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২টি পরীক্ষাগারে ১৩ হাজার ১৩৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৪৩ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া যায়। সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৫৭৮ জন।

বেশির ভাগ আক্রান্ত ও মৃত্যু তৃতীয় মাসে
দেশে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সংক্রমণের প্রথম মাসে রোগী শনাক্ত হয় ২১৮ জন, যা এখন পর্যন্ত মোট রোগীর শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। দ্বিতীয় মাসে রোগী শনাক্ত হয় ১২ হাজার ৯১৬ জন, যা মোট আক্রান্তের ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর তৃতীয় মাসে গতকাল রোববার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে মোট ৫২ হাজার ৬৩৫ জন, যা মোট আক্রান্তের শতকরা ৮০ ভাগ।

সংক্রমণ শনাক্তের তৃতীয় মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। শনাক্তের ৮০ শতাংশ এবং মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ হয়েছে তৃতীয় মাসে।

প্রথম মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০ জন। দ্বিতীয় মাসে ১৮৬ জন। আর তৃতীয় মাসে মারা গেছেন ৬৮২ জন। মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৭ শতাংশ হয়েছে তৃতীয় মাসে।

আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যার পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হারও বেড়েছে দ্রুত। সংক্রমণের প্রথম মাসে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৫ হাজার ৪৪টি। ওই মাসে পজিটিভ বা কোভিড-১‌৯ শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় মাসে মোট ১ লাখ ১১ হাজার ৪৫৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এই মাসে পজিটিভ শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তৃতীয় মাসে এসে পরীক্ষা এবং শনাক্তের হার—দুটোই অনেক বেড়ে যায়। তৃতীয় মাসে (৯ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত) নমুনা পরীক্ষা করা হয় ২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৪৩টি। গড়ে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

আরও বাড়ার আশঙ্কা
সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে সেটা ছিল ঢিলেঢালা। এরপর ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়। এর দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণের দশম সপ্তাহে (১০–১৬ মে) বা তৃতীয় মাসের শুরু থেকে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে।

চলতি সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ শনাক্তের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ গত মাসের শেষের দিকে প্রচুর মানুষ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে যাতায়াত করেছেন। কেনাকাটার জন্য দোকানপাটও ছিল উন্মুক্ত। ঈদের পর গত ৩১ মে থেকে ছুটি বা লকডাউনও উঠে গেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এর প্রভাব দেখা যাবে বলে মনে করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম  বলেন, পোশাক কারখানা খোলা ও ওই সময়ের শিথিলতার দুই সপ্তাহ পর থেকে সংক্রমণ শনাক্তের হার বাড়তে শুরু করে। এখনো তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ঈদের সময় যে শিথিলতা এবং পরে লকডাউন তুলে দেওয়ার প্রভাব আর দু–এক দিনের মধ্যে দেখা যাবে। শনাক্তের হার ২৫ শতাংশের ওপরে চলে যেতে পারে। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবার জন্য খাবার ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে জোনভিত্তিক কার্যকর লকডাউনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ মুহূর্তে আক্রান্তের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশে সংক্রমণের চতুর্থ মাস শেষ হয়েছে। বাকি ৯টি দেশের চতুর্থ মাস চলছে। বাংলাদেশে কাল থেকে শুরু হবে চতুর্থ মাস। এর মধ্যে ১৩টি দেশে চতুর্থ মাসেও সংক্রমণরেখা ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেছে। কোনো কোনো দেশে পঞ্চম মাসেও সংক্রমণ বাড়ছে।

তবে ছয়টি দেশে তৃতীয় মাসের শেষ দিক থেকে সংক্রমণ কমার প্রবণতা দেখা যায়। এর পাঁচটিই ইউরোপের দেশ—স্পেন, ইতালি, জার্মানি, তুরস্ক ও ফ্রান্স। অন্যটি চীন।

সংক্রমণের শীর্ষ দশে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইতালি, পেরু, জার্মানি ও ইরান। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ভারত ও জার্মানিতে চলছে সংক্রমণের পঞ্চম মাস। ভারত ও রাশিয়ায় পঞ্চম মাসেও সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে চতুর্থ মাসেও ঊর্ধ্বগতি ছিল, এখন কমতির দিকে।

ব্রাজিল, পেরু ও ইরানে চলছে সংক্রমণের চতুর্থ মাস। এর মধ্যে পেরুতে গতকাল থেকে চতুর্থ মাস শুরু হয়েছে। এই দেশগুলোতে সংক্রমণ এখনো দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, আক্রান্তে দ্বিতীয় শীর্ষে থাকা ব্রাজিলে চতুর্থ মাসের ১১ দিনে শনাক্ত হয়েছেন আড়াই লাখ রোগী।

সংক্রমণের শীর্ষ ১১ থেকে ২০তম স্থানে আছে চীন, ফ্রান্স, তুরস্ক, চিলি, মেক্সিকো, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কানাডা, কাতার ও বাংলাদেশ। এর মধ্যে তুরস্ক, ফ্রান্স ও চীন বাদে অন্য দেশগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যু এখনো ঊর্ধ্বমুখী। অন্য এসব দেশে সংক্রমণের চতুর্থ মাস চলছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, দেশটিতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩০ জানুয়ারি। এখন চলছে সংক্রমণের পঞ্চম মাস। এখন সেখানে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ভারতে প্রথম মাসে শনাক্ত হয় ৩ জন রোগী। দ্বিতীয় মাসে ১ হাজার ২৪৮ জন। তৃতীয় মাসে ৩১ হাজার ৭৯৯ জন। আর চতুর্থ মাসে শনাক্ত হয় ১ লাখ ৪৯ হাজার। পঞ্চম মাসের প্রথম ছয় দিনেই শনাক্তের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার।

দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে দেখা গেছে তৃতীয় মাসে আক্রান্ত হন ৪৪ হাজার ৫০৮ জন। আর চতুর্থ মাসের প্রথম ১১ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ হাজার।

বাংলাদেশে পরীক্ষার সংখ্যা কম হলেও সংক্রমণের ধারা এসব দেশের মতোই। রোগতত্ত্ববিধ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এত দিন পর্যন্ত দেশে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে শিথিলতা ছিল। এখন জোনিং করে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটা ভালোভাবে কার্যকর হলে অবস্থার উন্নতি হবে। তবে কতটা নিবিড়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর সংক্রমণ কমা বা বাড়া নির্ভর করবে।

 

সুত্রঃ প্রথম আলো