দেশে করোনা চিকিৎসায় শুরু হচ্ছে প্লাজমা থেরাপি

মৃত্যু রোধ এবং দ্রুত আরোগ্যের জন্য দেশে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলক প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এ সংক্রান্ত নীতিগত অনুমোদনও নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেসব করোনা রোগী আছেন, তাদের ওপরই এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে।

এ ছাড়া ঢাকার আরও দু-একটা হাসপাতালে রোগীদের ওপর এই থেরাপি প্রয়োগের পরিকল্পনা আছে। চীন, আমেরিকাসহ অন্যান্য অনেক দেশে ইতোমধ্যে করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির সফলতা প্রমাণিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ খান বলেন, এটি একটি পরীক্ষিত চিকিৎসা পদ্ধতি, বিশেষ করে যখন কোনো রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই এবং সুস্পষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থাও নেই।

সে ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর ও পরীক্ষিত চিকিৎসা পদ্ধতি।

তিনি বলেন, চীনে এই থেরাপি ব্যবহারের প্রথমদিকে ১০ জন অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে এটি প্রয়োগ করে দেখা গেছে তারা সবাই দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। অপরদিকে একই সময় অন্য দশজন অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্লাজমা না দিয়ে প্রথাগত চিকিৎসা দেয়ায় তাদের মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু ঘটে। তাই করোনা চিকিৎসায় এর সফলতা প্রমাণিত।

এ কারণে গত ৩ এপ্রিল ইউএসএফডিএ এটির পরীক্ষামূলক ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। অধ্যাপক খান বলেন, ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এ সংক্রান্ত নীতিগত অনুমোদন নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সেন্টার হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এ ছাড়া কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। আমাদের ক্রাইটেরিয়ামতো রোগী পাওয়া গেলে তাদের ওখানেও করতে পারি। কিছু ডোনার আমাদের হাতে আছে। যারা ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছেন, তাদের আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন প্লাজমা দিতে এগিয়ে আসেন।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের রোগী দিন দিনই বাড়ছে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৮ হাজার ৮৬৩ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছে ২৮৩ জন। রোগী বাড়তে থাকায় চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।এরই অংশ হিসেবে প্লাজমা থেরাপি দেয়া শুরু হচ্ছে।

জানা গেছে, কোভিড মহামারীর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে গত ২৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগে একটি প্রটোকল প্রণয়ন করেছে। যা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিএমআরসিতে জমা দেয়া হয়েছে।

দেশে প্রাথমিকভাবে ৪৫ জন কোভিড আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্লাজমা প্রয়োগ করা হবে। একই সঙ্গে অপর ৪৫ জনকে প্লাজমা ছাড়া অন্য চিকিৎসা দেয়া হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লেগে যাবে। এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশে মুমূর্ষু রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হবে।

রক্তরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষের রক্তে ৫৫ শতাংশ প্লাজমা থাকে। আর ৪৫ শতাংশ থাকে রক্তের কোষ। রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করলে দেখা যাবে, এর মধ্যে ৯২ ভাগ পানি ও ৭ দশমিক ৫ ভাগ প্রোটিন।

এই প্রোটিনের মধ্যে থাকে এলবোমিন এবং গ্লোবমিন। গ্লোবমিনের মধ্যে থাকে ইমিউনো গ্লোবমিন। যা শরীরে এন্টিবডি তৈরি করে। যে কোনো সুস্থ মানুষের শরীরে কোনো ভাইরাস প্রবেশ করার তিন থেকে ৭ দিনের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেও এটি সত্য।

তবে করোনা আক্রান্ত রোগী পরপর দু’বার করোনা নেগেটিভ প্রমাণিত হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন অতিক্রান্ত না হলে তার শরীর থেকে প্লাজমা নেয়া যাবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ১৫-১৮টি অ্যাফরেসিস মেশিন (মানবদেহ থেকে সরাসরি প্লাজমা নেয়ার যন্ত্র) রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল কলেজে এই মেশিন রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল এবং নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে এই মেশিন কার্যকর। এই মেশিনের সাহায্যে একজন মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে ২০০ এমএল প্লাজমা তৈরি করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে একটি মেশিন দিয়ে দৈনিক ১০-১২ জনের প্লাজমা সংগ্রহ সম্ভব।

জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাতা নির্বাচন।

কারণ, নারী, বৃদ্ধ এবং শিশুদের শরীর থেকে প্লাজমা নেয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়। ২০-৩৫ বছর বয়সীদের শরীরের এন্টিবডি শক্তিশালী থাকে। তাই এই বয়সী করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছে এমন লোকজনকে দাতা হিসেবে নিতে হবে।

তারপর যেসব মুমূর্ষু রোগীকে প্লাজমা দেয়া হবে তাদের। কারণ, প্লাজমা তৈরি করার পরপরই সেটি রোগীর শরীরে দিতে হয়। তিনি বলেন, একজন সুস্থ সক্ষম মানুষের শরীর থেকে প্রতি কেজিতে ১০ মিলি. পরিমাণ প্লাজমা নেয়া যায়।

ডা. এমএ খান জানান, দাতার শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ কিট প্রয়োজন হয়। প্লাজমাদাতার রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ জানতে যে পরীক্ষা করতে হয়, সে জন্য স্পেন থেকে চারটি কিট আনার আদেশ দিয়েছেন তারা। প্রতিটি কিটের দাম পড়বে দেড় লাখ টাকা করে। একটি কিটে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়।

আপাতত ঢাকা মেডিকেলের নিজস্ব খরচে পরীক্ষামূলক পর্যায় শুরু করা হলেও বড় আকারে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গেলে সরকারের সহায়তা লাগবে বলে জানান এ চিকিৎসক।

তিনি বলেন, প্লাজমা সংগ্রহের কিট আমাদের হাতে অল্প কয়েকটা আছে। আমরা চাইলেই ডোনারের কাছ থেকে কিটের খরচ নিতে পারি না। আর রোগীরাও এই খরচ দেবে না। এ জন্য সরকারকে এগুলো সরবরাহ করতে হবে।

পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বলে রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেয়ার পর আরও কিছু পরীক্ষা করাতে হয়। কিছু পরীক্ষা ঢাকা মেডিকেলে হয়, কিছু পরীক্ষা বাইরে করাতে হবে।

সে জন্যও আলাদা খরচ আছে জানিয়ে অধ্যাপক খান বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। তারা এখনও নিশ্চুপ। তারা বলেছে মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়েছে। আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করার সম্ভাব্যতা দেখতে এপ্রিলের শুরুতে আগ্রহের কথা জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজির অধ্যাপক ডা. এমএ খান। ১৯ এপ্রিল তাকে সভাপতি করে ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করে ফ্রিজিং করতে হবে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে যাদের অবস্থা খারাপের দিকে, তাদের শরীরে এই প্লাজমা প্রয়োগ করা হবে।

কোভিড-১৯ হওয়ার পর জ্বর, কাশি ও গলাব্যথা শুরু হয়। ভাইরাসের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ফুসফুস আক্রমণ করে। এই প্রদাহকালীন নানা ধরনের সাইটোকাইন এবং ক্যামোকাইন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে ফুসফুস জ্বালা করে। যন্ত্রণা তাৎক্ষণিকভাবে লাঘব করতে পারে প্লাজমা।

এ প্রসঙ্গে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করছে। এতে ভালো ফল পাচ্ছে। তাছাড়া প্লাজমা থেরাপির পেছনে শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে।

এটি মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করে সেটি প্রমাণিত। তাই জটিল কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের বিষয়টি ইতিবাচক। সূত্র: যুগান্তর