দেশের ব্যাংকিং খাত রক্ষায় যা করা প্রয়োজন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যখন ক্যাসিনোর কয়েকজন অপরাধীকে ধরা হল, তখন আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, যাক অন্তত শুরু হল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মাঝ পথে এসে সেটি থেমে গেল। এখন কথা হল, ক্যাসিনোর মতো অপরাধীদের ধরতে প্রধানমন্ত্রী লাগবে কেন?

যদি সত্যিই দেশে চেইন অব কমান্ড থাকে তাহলে এখানে পুলিশ আছে, র‌্যাব আছে, সিভিল সার্ভিস আছে, কর্তৃপক্ষ আছে, অন্যান্য বাহিনী আছে, মন্ত্রীরা আছেন, তারা কেউই ক্যাসিনোর অপরাধীদের ধরতে পারলেন না। তাহলে তাদের শক্তির উৎসটা আসলে কোথায়?

তাহলে কি সরকারের মাঝে ‘সর্প হয়ে দংশন করো ওঝা হয়ে ঝাড়ো’র মতো কোনো বিষয় রয়েছে? আমি শুধু এ সরকারের কথাই বলছি না, সব সরকারের কথাই বলছি। কারণ সরকারের মধ্যকার কারও না কারও প্রশ্রয়েই তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, যে কারণে মন্ত্রী পর্যন্ত কেউই তাদের ধরতে পারেনি।

এখন তাদের আবার ওঝা হয়ে ধরছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এ খেলা বন্ধ করতে হবে। এটি করতে হলে একেবারে পরিষ্কার করে করতে হবে। শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। তা না হলে অর্থ খাতকে রক্ষা করা যাবে না, ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করা যাবে না।

আমি এখানে ভারতের একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। ভারত আমাদের চেয়ে অনেক বড় দেশ। আমাদের চেয়ে জনসংখ্যাও বেশি। সেখানে বড় ব্যাংকের সংখ্যা খুবই কম। বড়জোর ১৮-২০টি এবং এগুলো জাতীয় পর্যায়ের বড় ব্যাংক। অবশ্য ছোট ছোট অনেক ব্যাংকও আছে।

আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকতে ভারতে গিয়েছি এবং ওদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছি। তারা আমাকে একটা কথা বেশ স্পষ্ট করে বলেছেন- ‘ভারতের বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয় না।

কারণ তাহলে তারা জনগণের টাকা দিয়ে ব্যবসা করবেন। এজন্য জনগণের টাকা রক্ষা করার জন্য আমরা অন্য একটি শ্রেণিকে লাইসেন্স দেই যারা পেশাগতভাবেই ব্যাংক চালাবে।’ আজকে এতদিন পরে এর মর্ম আমি বুঝতে পারছি। আমাদের দেশের ব্যাংকের মালিকরা অতি ধনী শ্রেণিরই অংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে পাওয়া গেছে এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রী সংসদেও সেটি পেশ করেছেন, ব্যাংকের মালিকরা ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা একটি বিরাট অঙ্ক। এ টাকা যদি ব্যাংকের মালিকরাই নিয়ে যান, তাহলে অন্য যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তারা টাকা পাবেন কোথায়?

আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিলাম, লুৎফর রহমান সরকার সাহেব ছিলেন গভর্নর। তখনও ব্যাংক মালিকরা তাদের নিজেদের ব্যাংক থেকে টাকা নিতেন। এটি আমরা ধরে ফেললাম। ধরে ফেলার পর ৩২ ব্যাংক পরিচালককে আমরা বহিষ্কার করলাম। তারপর ব্যাংক মালিকদের নিজ ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার বিষয়টি থেমে গেল।

থেমে যাওয়ার পর তারা শুরু করল লোন সোয়াপ সিস্টেমে লোন নেয়া। যেমন ‘এ’ ব্যাংক তার ডিরেক্টরকে লোন দেয় না। সে ‘বি’ ব্যাংক থেকে লোন নেয়। ‘বি’ ব্যাংকের ডিরেক্টরকে বলে, তুমি আমার কাছ থেকে নাও। এই করে করে দু’জনেই নিজের ব্যাংক থেকে না নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এটি নাকি অপরাধ নয়।

যখন পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা তাদের পেটে গেছে তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের চিন্তা করা উচিত যে, ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করতে হলে ব্যাংকের পরিচালকদের লোন সীমিত করতে হবে। নিজের ব্যাংক থেকে তো নেয়া যাবেই না, অন্য ব্যাংক থেকে নিতে হলেও সেটার একটি লিমিট থাকতে হবে। যেমন ছোটখাটো প্রয়োজনে নিতে পারবে। কিন্তু বড় ঋণ তারা নিতে পারবে না। এটি না করলে জনগণের টাকা ব্যাংক মালিকরা খেয়ে ফেলবে।

আরেকটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য, সেটি হল, লোন যাকে দেয়া হয় সেই লোনের মালিককে প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় না, লোন আদায় করা যায় না ইত্যাদি। এটি কেন হবে? আমিও ব্যাংকিং করেছি। করাচিতে আমার ব্যাংকিং জীবন শুরু।

আমাদের সময়ে লোন দেয়ার একটা নিয়ম ছিল, লোন দেয়ার সময়ে কোন ম্যানেজার লোনটি রিকমেন্ড করলেন, কোন এমডি বা জিএম এটি অনুমোদন করলেন তার রেকর্ড থাকবে। একেবারে খাতাপত্রে সেটি দেখা যেত। ওই লোনটি যদি আটকে যায় তাহলে ওই জিএম ও ম্যানেজারের চাকরিতে থাকার উপায় ছিল না।

ফলে আমাদের সময়ে ঋণখেলাপি খুব একটা হতো না। সে সময়ে আধা বা এক পার্সেন্ট মন্দ ঋণ হতো। আজকে এতকিছুর উন্নতির পরও বেশি মন্দ ঋণ হচ্ছে কেন? এর জবাবদিহিতা কেন থাকছে না? ওই রেজিস্টারটি আবারও চালু করা হোক।

লোন দেয়ার সময় কোন ম্যানেজার এ লোনটি রিকমেন্ড করলেন এবং কে এটাকে অনুমোদন করলেন সেটির রেকর্ড থাকবে এবং সেই লোন খারাপ হলে সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে। এটি যদি করা যায় তাহলে ব্যাংক ব্যবস্থার স্বার্থ রক্ষিত হবে এবং আমানতকারীর স্বার্থও রক্ষা পাবে।

সবকিছুই নির্ভর করে সরকার, যারা দেশ চালায়, তাদের কমিটমেন্টের ওপর। আমার মনে হয় সরকারের উচিত হবে শুরুতেই আবদুল হাই বাচ্চুকে ধরে শাস্তির আওতায় আনা। কেউ কেউ বলছেন, তিনি দোষী নন তাই তাকে ধরা হচ্ছে না। একথা বললে হবে না, তিনি দোষী নন।

তিনি দোষী না হলে তাহলে কে দোষী? ব্যাংকের ৮০ শতাংশ টাকা মেরে দেয়ার সাধ্য কার আছে? এটি এমডি ও চেয়ারম্যান মিলে না করলে হয় না। এ ধরনের কুযুক্তি না দেখিয়ে তাকে ধরা উচিত।

শুধু আবদুল হাই বাচ্চুকেই নয়, যেসব ব্যাংক পরিচালক এসব দুষ্টচক্রকে প্রশ্রয় দেবে, তাদের চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেয়া। তাহলে মানুষের মাঝে একটা সিগন্যাল যাবে যে, সরকার সিরিয়াস হয়েছে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে।

ব্যাংক পর্যায়ে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এমডি এবং উচ্চপর্যায়ে যারা রয়েছেন, তাদেরকে মালিকের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর এর দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। নিয়ম আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কনট্রাক্ট পিরিয়ডের মধ্যে কোনো এমডিকে কোনো ব্যাংকের মালিক সরাতে পারবে না।

কোনো এমডি যদি পদত্যাগপত্রও দেন তাহলেও বাংলাদেশ ব্যাংক খোঁজ নিয়ে দেখবে যে, তাকে জোর করে পদত্যাগপত্র দেয়ানো হচ্ছে কিনা। এই যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি এর কোনো বিকল্প নেই। ওইখানটায় বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেছে। আগে যেটুকু পারত এখন সেটিও পারছে না। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সবকিছুতেই নমনীয়।

সরকারের পক্ষ থেকে যখন কোনো অবাঞ্ছিত প্রস্তাব আসে তখন তারা অবনত মস্তকে সেটি মেনে নিচ্ছে। যেমন- খেলাপি ঋণের সংস্কারের ক্ষেত্রে সবসময় করতে হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। আর যারা ভালো ঋণগ্রহীতা তাদের ভালো কিছু দিতে হয়। বাংলাদেশে হয়ে গেছে এর উল্টো।

নতুন অর্থমন্ত্রী আসার পর যারা খেলাপি তাদের তিনি আশ্বস্ত করলেন, এখন থেকে কোনো খেলাপি জেলে যাবে না। তারপর তিনি বললেন, যারা খেলাপি তাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হবে। আগের তিন মাস ইন্সটলমেন্ট বন্ধ হলেই তিনি খেলাপি হবেন। এখন ৯ মাস পর্যন্ত তাদের সময় দেয়া হচ্ছে।

এ ৯ মাসের মধ্যে খেলাপিরা যদি টাকা দেন তাহলে তিনি খেলাপি হবেন না। এটি কি কোনো গ্রহণযোগ্য ভালো প্রস্তাব হল? দ্বিতীয়টি আরও মারাত্মক, মাত্র ২ পারসেন্ট টাকা জমা দিয়ে যত পুরনো লোনই হোক না কেন, ’৭২ সালের খেলাপি ঋণও যদি হয় সেটাকে খেলাপিমুক্ত করা হবে ১০ বছরের জন্য।

এটি নিঃসন্দেহে খুবই আপত্তিজনক প্রস্তাব। যতদূর শুনেছি, প্রস্তাবটি এসেছে মন্ত্রণালয় থেকে ইংরেজি ভাষায় লেখা। যিনি এটি ড্রাফ করেছেন তিনি হয়তো বাংলা জানেনই না। তারপর এটি দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে, সেখান থেকে ওইভাবেই চলে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে এটিকে ইস্যু করার জন্য।

আমি তো মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। কারণ আইনে আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারের পরামর্শ হতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকার কোনো নির্দেশ দিতে পারে না। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকার নির্দেশ দিচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি অবনত মস্তকে মেনে নিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিদেশে কী হয় তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। চীনে যখন মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হল, তখন তাদের অনভ্যস্ততার জন্য খেলাপি ঋণ বেড়ে গেল। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইনে যেসব ব্যবস্থা আছে সেটি তো থাকবেই তার পাশাপাশি সরকার থেকে কতগুলো নির্দেশ জারি করা হল।

নির্দেশগুলো হল খেলাপি হওয়া মাত্রই খেলাপি ব্যক্তির পাসপোর্ট বাতিল করা হবে এবং প্রতিটি বিমানবন্দর, বাস ও রেলস্টেশনে ছবি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হবে, যাতে সে দেশের বাইরে যেতে না পারে। তিনি যদি ভিআইপি-সিআইপি হন সেটাও বাতিল হয়ে যাবে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, এমনকি কমিউন পর্র্যায়েরও যদি তিনি কোনো মেম্বার হয়ে থাকেন সেটিও বাতিল হয়ে যাবে। এ রকম শর্ত দেয়ার পর দেখা গেল খুব অল্পদিনের মধ্যেই খেলাপি ঋণের অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। এ ব্যবস্থা এখনও চলমান আছে। আজকেও চীনের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মাত্র ১.৩ শতাংশ।

তাহলে আমাদের দেশে এটি কেন হচ্ছে না? এসব উদাহরণ কেন অর্থমন্ত্রী নিচ্ছেন না? এ না নেয়ার কারণটি তাহলে কী? অর্থমন্ত্রী একজন বড় ব্যবসায়ী সেটি? অর্থমন্ত্রী নিজে একজন বড় ব্যবসায়ী হওয়ায় এবং বড় ব্যবসায়ীদের যে গোষ্ঠী, তিনি নিজের ওই গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিচ্ছেন?

এ কারণে সবখানেই একটা নিয়ম আছে- বড় কোনো ব্যবসায়ীকে অর্থমন্ত্রী পদে বসানো হয় না। যদি বসাতেই হয় তাহলে তিনি যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালান সেখান থেকে পদত্যাগ করে আসতে হবে। আগে যারাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা কেউই ব্যবসায়ী ছিলেন না। এটি আসলে আইন নয়, একটা রীতি; যেটি সব দেশ মেনে চলে।

আমরা যদি মোট অঙ্কটা একটু দেখি তাহলে দেখব, আমাদের এখন ১১ লাখ কোটি টাকা ঋণ আছে। এর মধ্যে ১০ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হল ভালো ঋণ। কম-বেশি মাত্র ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। তাহলে একই সুদ দিয়ে ১০ লাখ কোটি টাকা যদি ভালো ঋণ থাকতে পারে, ১ লাখ কোটি টাকা কেন মন্দ ঋণ আকারে থাকবে? এর জন্য কী কারণ থাকতে পারে।

আমি মনে করি, বর্তমান অব্যস্থাপনা ও অদূরদর্শিতার কারণে খেলাপিদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এতে করে ব্যাংকিং সেক্টরে একটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সেটি হলে আমাদের যে অর্থনীতি সেটি বাধাগ্রস্ত হবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে থেকে যারা খেলাপি এবং যারা ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয়, তাদের প্রতি কোনো আশীর্বাদ থাকতে পারবে না।

অনেকেই বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ভালো। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা ভালোই বলতে পারবেন। প্রবৃদ্ধির মানে হল গত বছর যে প্রবৃদ্ধির হার ছিল তার সঙ্গে যদি এক্সপেন্ডিচার, বিশেষ করে বড় বড় পাবলিক এক্সপেন্ডিচার যোগ করা হয় সেটাই হল প্রবৃদ্ধির হার।

এখন বর্তমানে দেশে পদ্মা সেতু, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো উন্নয়নসহ অনেক বড় বড় প্রকল্পে টাকা ব্যয় হচ্ছে। আমরা বলতে পারি, সেখানে থাউজেন্ডস অব ডলার ক্ষয় হচ্ছে। ওই খরচের টাকাটাই খরচের সঙ্গে যোগ হয়। এটাই অর্থনৈতিক ফর্মুলা। যে কারণে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের খুব উন্নতি হচ্ছে।

বিদেশের প্রবৃদ্ধিতেও এক্সপেন্ডিচার যোগ হয় এটি ঠিক আছে; কিন্তু এর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথটিও যোগ করে প্রবৃদ্ধি ধরা হয় এবং সেটাই তাদের মূল প্রবৃদ্ধি। আমাদের এখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল যে গ্রোথ সেটি নেই। কারণ ব্যাংকের মাধ্যমেই তো মেশিনপত্র আসে। সেই মেশিনপত্র আসা অনেক কমে গেছে।

এমনকি পুরনো ইন্ডাস্ট্রি চালানোর যে কাঁচামাল সেটি আসাও কমে গেছে। পুরনো ইন্ডাস্ট্রি ভালোভাবে চলছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে জিডিপি বাড়ে কী করে? এর ফর্মুলা হল পাবলিক এক্সপেন্ডিচার। সেজন্য আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।

এ ব্যাংকিং সিস্টেমে উন্নতি করার জন্য আমি একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। যেটি ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং করেছিলেন। মনমোহন সিং ভারতের একজন অত্যন্ত নামকরা অর্থনীতিবিদ। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। পরে ভারতের অর্থমন্ত্রী হন। সবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দেশের সেরা পাঁচজন অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি ‘অর্থনীতিবিদ কাউন্সিল’ গঠন করেন। এ সেরা পাঁচ অর্থনীতিবিদ বেতন ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর অ্যাডভাইজার হন।

প্রথম মিটিংয়ে একজন অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংকে প্রশ্ন করলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো একজন অত্যন্ত উঁচুমানের অর্থনীতিবিদ, তাহলে আপনাকে আমাদের পরামর্শ দেয়ার কী দরকার?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি একজন স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ এটি সত্য; কিন্তু এক মাথা থেকে পাঁচ মাথা উত্তম।

আপনাদের পাঁচজনে যে কথাগুলো বলবেন সেটি কানে এলে আমার নিজের অনেক ভুল কেটে যেতে পারে। আমি মানুষ, তাই আমার নিজেরও ভুল হতে পারে। অনেক সময় বড় বড় চিন্তাশীল লোকরাও একটা চিন্তার মধ্যে আটকে যায়, বেরুতে পারে না। তাই আমিও আটকে যেতে পারি। আপনারা আমার সেই আটকে যাওয়া ফিক্সেশন থেকে বের করে আনবেন। এজন্যই আমি আপনাদের নিয়ে বসতে চাই।’

মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ যদি অন্যান্য অর্থনীতিবিদের সঙ্গে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পারেন, তাহলে আমরা কেন পারব না? তাই আমি অনুরোধ করব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অনেক কিছু দেখতে হয়, অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয়।

তাই অর্থনীতির জন্য আপনি বাংলাদেশের সেরা আপনার পছন্দমতো অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করুন। তাদের বেতন দেয়ার দরকার নেই। আপনি মাঝে মাঝে তাদের ডিনারে ডাকবেন। প্রসঙ্গক্রমে তারা অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন, আপনি শুনবেন, তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা ভালো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর