দেশের বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে সেনাবাহিনী

সেই ১৯৭১ সাল থেকে দেশমাতৃকার ডাকে সবসময় সাড়া দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এরপর থেকে দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো প্রয়োজনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে অর্পিত দায়িত্ব। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধস ইত্যাদি বড় বড় দুর্যোগে পর্যাপ্ত সেবা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে সেনাবাহিনীর তাৎক্ষণিক প্রয়াস চোখে পড়ার মতো। আবার দেশের বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছে সর্বশক্তি। দক্ষতার চূড়ান্ত প্রমাণ রেখেছে।

অবকাঠামো নির্মাণে রাজধানীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল প্রকল্প। ঢাকার বাইরে মহীপাল ফ্লাইওভার, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়ক, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণ, ৬ষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর সংযোগ সড়কে বিকল্প সড়ক নির্মাণ, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্পের পাশাপাশি পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পেও অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

দেশের বাইরে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেমন দেশের জন্য সুনাম অর্জন করেছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ কাজে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনী দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।

হাতিরঝিল প্রকল্প

ব্রিটিশ রাজার ধারাবাহিকতায় ভাওয়ালের রাজাদের পোষা হাতি রাখা হতো পিলখানায়। সে সময় গোসল করার জন্য এসব হাতি ঝিলে নিয়ে যাওয়া হতো যেখানে, সেই জায়গাটিই আজকের হাতিরঝিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এ এলাকার অবস্থা কী ছিল, তা সবারই জানা আছে। এ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধে নাক চেপে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। এক হাঁটু কাদার ভেতরে গাদাগাদি বস্তিঘর ছিল।

সেই হাতিরঝিল এলাকাটিকে রূপকথার ছবির মতো সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। একসময়ের তীব্র দূষণের হাতিরঝিলে এখন চারটি ওভারপাস, ভায়োডাক্ট, রামপুরা থেকে টঙ্গী ডাইভারশন রোড পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, প্রকল্পের ভেতরে আরও আট কিলোমিটার সড়ক, তিনদিকে বিস্তৃত ঝিলের পাড় ঘেঁষে ওয়াকওয়ে, পাড়ে বসার জন্য ঘাট। বোটে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ট্যাক্সিওয়ে। ফুরফুরে বিশুদ্ধ বাতাস। অবিশ্বাস্য হলেও হাতিরঝিলের এ মনোরম দৃশ্যই এখন বাস্তবতা।

হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে রাজধানীর মধ্যাঞ্চলে এখন আর জলাবদ্ধতা নেই। চারপাশে পাম্প স্থাপন করায় আশপাশে পানি সংকটও দূর হয়েছে। কারওয়ানবাজার-বাংলামোটর থেকে রামপুরা যেতে সময় লাগছে মিনিট কয়েক।

গুলশান-বাড্ডায় যাওয়া-আসা করা যাচ্ছে সহজে। আট কিলোমিটার এক্সপ্রেস সড়ক দিয়ে দ্রুতগতির যান চলাচল করছে। এ সড়কের পাশে আরও আট কিলোমিটার সার্ভিস পথে রিকশাসহ যে কোনো যান চলাচল করতে পারবে। এক্সপ্রেস সড়কে রয়েছে চারটি দৃষ্টিনন্দন ওভারপাস। শুধু সড়কপথেই নয়, পানিপথে মগবাজার থেকে ওয়াটার বাসে চড়ে গুলশান-বারিধারায় যাতায়াতের সুযোগও রয়েছে।

আছে ফুটপাত ছাড়াও নির্বিঘ্নে হেঁটে চলার জন্য প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ। তেজগাঁও দক্ষিণ কুনিপাড়ার সামনেও ব্রিজের সংযোগ সড়ক এবং টঙ্গী ডাইভারশন রোড-প্রগতি সরণি সংযোগ সড়কের পাশে একটি কার ও সাইকেল পার্কিং আর গুলশান অংশে একটি কার পার্কিং নির্মাণ করা হয়েছে।

ঝিলে সব স্যুয়ারেজ কানেকশন বন্ধ করা হয়েছে। এমনকি গৃহস্থালির বর্জ্য যেন বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে ঝিলে আসতে না পারে সেজন্য দুই পাশের রাস্তায় দুটি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ঝিলের পানি আর দূষিত হওয়ার সুযোগ থাকছে না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন, ঢাকা ওয়াসা এবং এলজিইডি যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

দেশের প্রথম ছয় লেনবিশিষ্ট ফ্লাইওভার

ফেনীর মহীপালে চালু হওয়া দেশের প্রথম ছয় লেনবিশিষ্ট ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই। ২০১৫ সালের এপ্রিলে শুরু করা ছয় লেনের ফ্লাইওভার ২০১৮ সালের জুনে শেষ হওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও ছয় মাস আগেই তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। চলতি ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ ফ্লাইওভার উদ্বোধন করেন।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহীপালে নবনির্মিত ছয় লেনবিশিষ্ট ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৮১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। মূল ফ্লাইওভারটির দৈর্ঘ্য ৬৬০ মিটার। প্রস্থ ২৪.৬২ মিটার। সার্ভিস রোডের দৈর্ঘ্য ১৩৭০ মিটার, প্রস্থ ৭.৫ মিটার। অ্যাপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্য ১১৬০ মিটার। বিশ্বরোড থেকে একটি সড়ক ফ্লাইওভারে যাবে, অন্যটি সাইড দিয়ে এসে লিঙ্ক রোড হিসেবে ফেনী শহর ও ফেনী-নোয়াখালী সড়কে মিশেছে।

এ ফ্লাইওভারের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি ওপরে ছয় লেন ও নিচে চার লেন। সে হিসেবে মহাসড়কের মহীপালের এ অংশটি ১০ লেনের। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগে প্রকল্পটির নির্মাণ সম্ভব হয়েছে প্রকল্পের সঙ্গে সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট থাকায়। সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারসাজি অনেকাংশে দায়ী- এমন অভিযোগ প্রবল।

প্রকল্প এলাকার রাজনৈতিক টাউট ও চাঁদাবাজদের তৎপরতাও বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকে বলে কথিত আছে। ফেনীর মহীপালের ছয় লেন ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধক না থাকায় নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।

মহীপালের ছয় লেনের ফ্লাইওভার দেশের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এ ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথে যানজট এড়ানো সহজতর হয়েছে। ছয় লেনবিশিষ্ট ফ্লাইওভার নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের আওতায় ১৪টি নতুন স্টেশন ভবন ও ছয়টি স্টেশন পুনর্নির্মাণ, ৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু এবং ২৪৪টি ছোট সেতু নির্মাণ, ১০০টি নতুন রেলকোচ কেনা এবং আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেমের জন্য অপটিক্যাল ফাইবার লাইন স্থাপন করা হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি। পদ্মা সেতুতে রেললাইন সংযোগ প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট (সিএসসি)। এ কাজে সিএসসিকে সহযোগিতা করবে বুয়েটের বিআরটিসি (ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেন্ট)।

এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর কাছে ন্যস্ত পদ্মা বহুমুখী সেতুর তিনটি প্রকল্পের মধ্যে দুটি প্রকল্প যথাসময়ে সম্পন্ন করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কর্মদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের নতুন মাইলফলক রচনা করেছে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট, সিএসসি। এ প্রকল্পে পরামর্শক সেবার আওতায় নির্মাণকাজের সুষ্ঠু তদারকিসহ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করবে সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট সেল (সিএসসি) অব কোর অব ইঞ্জিনিয়ারিং। চুক্তি অনুসারে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের তদারকি নিশ্চিত করবে সেনাবাহিনী।

অন্যান্য প্রকল্প

২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। ২০১২ সালে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পর ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর এই ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করা হয়। ৫২.৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়কটিও নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারটিও নির্মিত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে ধানমণ্ডি লেক উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ সাল- এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। ৬ষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর সংযোগ সড়কের দুটি ক্ষতিগ্রস্ত সেতুর বিকল্প সড়ক নির্মাণ ও সেতু দুটির সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ কাজও সেনাবাহিনী সম্পাদন করবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পটিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাস্তবায়িত করেছে। ২০১৭ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।

শেষ কথা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি চৌকস প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সেবায় নিয়োজিত। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে সেনাবাহিনী দক্ষতার পরিচয় রেখে প্রমাণ করেছে, যে কোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় সেবা নিয়ে মানুষের পাশে আছে।

আলী হাবিব : সাংবাদিক

habib.alihabib@gmail.com