দুর্গাপুরে হোজা নদীতে অবৈধভাবে লিজ: পনিতেও নামতে পারছেন না জেলেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর দুর্গাপুরে ঐতিহ্যবাহী হোজা নদীতে মাছ শিকার করে মামলার আসামি হয়েছেন ১৫ জন জেলে। রাজশাহী নগরীর ফরিদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসন থেকে লিজ নিয়ে ওই নদীতে আর কোনো জেলেকে মাছ শিকার করতে দিচ্ছেন না। তার বাধা উপেক্ষা করে জেলেরা মাছ শিকার সম্প্রতি ১৫ জনের নামে আদালতে মামলাও করেছেন ফরিদুল। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় জেলেদের মাঝে। তাঁরা দ্রুত হোজা নদীর লিজ বাতিল করে সাধারণ জেলেদের মাছ শিকারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর তা না হলে দুর্গাপুরের অন্তত ২৫টি গ্রামের জেলে ও সাধারণ মানুষ তীব্র আন্দোলনের নামার ঘোষণা দিয়েছেন।

দুর্গাপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্র মতে, প্রায় ৪ বছর আগে দুর্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী হোজা নদীটি লিজ দেওয়া হয় রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে। নদীর প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকা (পলাশবাড়ি থেকে হরিপুর পর্যন্ত) লিজ দেওয়া হয় পানির দামে। এরপর থেকে ওই নদীতে বাঁশের ফালি দিয়ে ঘের করে মাছ শিকার করছেন লিজ গ্রহণকারী ফরিদুল্লাহ ও তাঁর লোকজন। সেই থেকে নদীতে মাছ শিকারে নামতে গেলেই জেলেদের নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মাছ শিকারের কারণে সম্প্রতি উপজেলার ১৫ জন জেলেকে আসামি করে মামলা করেছেন ফরিদুল। মামলাটি তদন্ত করে এরই মধ্যে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম প্রতিবেদন দিয়েছেন আদালতে।

উপজেলার পলাশবাড়ি গ্রামের মাহাবুব রহমান বলেন, ‘গত প্রায় ৫ বছর ধরে হোজা নদীতে আমরা জেলেরা নামতে পারছি না। এই বয়সে অন্য কোনো পেশায় নামতেও পারছি না। এরই মধ্যে মাঝে মধ্যে হোজা নদীতে জাল নিয়ে নামলেও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান ফরিদুলের লোকজন।’

একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একদিন নদীতে মাছ ধরার কারণে অন্তত ১৫ জনের নামে মামলা করেছে ফরিদুল। ওই মামলার ভয়ে আর কোনো জেলে এখন আর নদীতে নামতে সাহস পাচ্ছে না। মামলায় আমাকেও আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন কি করে খাবো?’

দুর্গাপুরের সিংঙ্গা গ্রামের বাহার আলী বলেন, ‘নদী দিয়ে লিজ দিয়ে জেলেদের সঙ্গে তামাশা করছে প্রশাসন। আমরা এই নদীর লিজ বাতিলের আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু তার পরেও লিজ বাতিল করা হয়নি। আমরা নদীতে নামলেই আমাদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে কতদিন চলবে। এইভাবে চলতে থাকলে আমরা আন্দোলন শুরু করবো নদী রক্ষার জন্য। নদী লিজ দিয়ে জেলেদের মারার পাশাপাশি নদীকেও মেরে ফেলা হচ্ছে।’

এদিকে উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র মতে, সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী উন্মক্ত জলাশয় লিজ দেওয়া যাবে না। উন্মক্ত জলাশয়ে কোনো ব্যাক্তি ব্যাক্তিগতভাবে মাছ চাষ করতেও পারবে না। এ ক্ষেত্রে ‘জাল যার, জলা তার’ নীতি ওই জলাসয় ব্যবহার হবে। কিন্তু সেই নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে রাজশাহী জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দুর্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী হোজা নদী লিজ দেওয়া হয়েছে গত ২০১৫ সালে। এরপর প্রতি বছর ওই লিজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ফলে সেখানে মাছ ধরা থেকে প্রকৃত জেলেদের বঞ্চিত করা হয়েছে। দুর্গাপুর উপজেলা সদরের মাঝ দিয়ে প্রবাহমান এই নদীটিতে মাছ শিকার করতে না পেরে পথে বসতে চলেছেন কয়েক শ দুস্থ, অসহায়, হতদরিদ্র মৎস্যজীবীরা।

জনশ্রুতি রয়েছে হোজা নদীর উজান খরসি অংশে ব্রিটিশ আমলে একদল সেনা ঘোড়া নিয়ে নদী পার হতে গিয়ে কয়েকটি ঘোড়াসহ ডুবে মারা যান। এরপর থেকে এখনো প্রতি বছর পহেলা কার্তিক সেখানে ঘোড়াদহ মেলা বসে। অথচ সেই নদী লিজ নিয়ে কোথাও কোথাও বাধ দিয়ে সেখানে এখন পুকুর তৈরী করছেন প্রভাবশালী সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা।

দুর্গাপুর উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, হোজা নদীর বিশাল একটি অংশ লিজ গ্রহণের জন্য দুর্গাপুর উপজেলার মৎস্যজীবী সমিতির পক্ষে আবদুর রহমান নামের এক ব্যাক্তি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের নিকট ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট নদীটি সম্পর্কে জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠি পাওয়ার পর উপজেলা মৎস্য অফিস ও নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে লিজ প্রদানের জন্য সুপারিশ করে ফিরতি চিঠি দেওয়া হয়। এরপর জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে ওই নদীর প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নামেমাত্র কয়েক লাখ টাকায় লিজ দেওয়া হয়।

রাজশাহী নগরীর ফরিদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি নদীটি লিজ নিয়ে তিনি পরে সাব লিজ দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগকর্মী আব্দুর রহমান, ছিদ্দিক হোসেন, আব্দুল হান্নানসহ আরো কয়েকজনের নিকট। এরপর তাঁরা নিজেদের অংশে কেউ বাঁশের বেড়া দিয়ে, কেউ জাল দিয়ে আবার কেউ রীতিমতো বাধ দিয়ে নদীর মাঝে পুকুরের মতো করে মাছচাষ করে আসছেন।

সাব লিজ গ্রহণকারী আবদুর রহমান বলেন, ‘সরকারকে টাকা দিয়ে লিজ নিয়েই নদীতে মাছচাষ করা হচ্ছে। এখানে অন্য কেউ আর মাছ ধরতে পারবে না। আমাদের মাছ আমরাই ধরবো। সেটা যেভাবে প্রয়োজন, সেভাবেই ধরা হবে। কাজেই অন্য লোক নদীতে নামতে পারে না।’
তবে লিজ গ্রহণকারী ফরিদুল্লাহ’র সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নদীটি কিভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে-তা জানা নাই। তবে যেভাবেই লিজ দেওয়া হোক, জেলেদের নদীতে নামতে দেওয়া প্রয়োজন। না হলে নদী পাড়ের জেলেরা মানবেতর জীবন-যাপন করতেই থাকবেন। এখানে জেলেরাই তো মাছ ধরার কথা। কাজেই জেলেদের নদী জেলেদের কাছেই ফিরে দেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিটন সরকার বলেন, ‘ নদীটি লিজ দেওয়া হয়েছে শুনেছি। তবে জেলেদের মাছ ধরতে বাধা দেওয়া হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স/র