দুর্গাপুরে জীবিত ব্যক্তি মৃত বানিয়ে পুনরায় জীবিত করেন চেয়ারম্যান!

এভাবেই জীবিত ব্যক্তিকে মৃত বানিয়ে পুনরায় জীবিত থাকার প্রত্যয়নপত্র দেন চেয়ারম্যান


আমজাদ হোসেন শিমুল:

‘রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ৪ নম্বর দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম। ২০১৬ সাল থেকে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তিনি। প্রথমবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়ে ৫ বছরে ইউনিয়নের নির্বাচিত ১২ জন সদস্যের প্রায় ৩ বছরের মাসিক ভাতা (১৮ লাখ ৪৮ হাজার) আত্মসাত করেছেন। শুধু তাই নয়; জেলহাজতে থাকা মাদক মামলার এক আসামির জামিন করিয়ে দিতে ওই আসামির মাতা মৃত্যুবরণ করে বলে সনদপত্র দেন তিনি। পরে রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত-৩ এর বিচারক বিষয়টির তদন্ত করতে দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। পরে তোপের মুখে ওই আসামির মা জীবিত আছে মর্মে প্রত্যয়নপত্র দেন ওই চেয়ারম্যান।’

চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে শুধু এই দুই অভিযোগ নয়; এমন শত শত অভিযোগের পাহাড় নিয়ে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নে (আরইউজে) কার্যালয়ে হাজির হয় ওই ইউনিয়ন পরিষদের ৮ জন নির্বাচিত ইউপি সদস্য। গতকাল বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে আরইউজে কার্যালয়ে ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। ইউপি সদস্যরা চেয়ারম্যানের এসব দুর্নীতি থেকে এলাকাবাসীর মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তপেক্ষ কামনা করেন।

দেলুয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যানের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিচার দাবিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা


 

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ৪ নম্বর দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান এস.এম আবুল বাশার বলেন, ‘গত ১ আগস্ট ইউপি সদস্য ও মাদক মামলার আসামি সাজাপ্রাপ্ত মো. কারুজ্জামান ওরেফে মো. কামরুল সরকারের  জামিন করার অভিনব কৌশল আটেন। ওই দিন কামারুজ্জামানের মা মোছা. জমেলা ভোর ৬টায় মৃত্যুবরণ করেছে মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন চেয়ারম্যান। এমনকি ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলেও প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ করা হয়। প্রকৃত অর্থে ওই মহিলা মৃত্যুবরণ করেছে কিনা সেই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত-০৩ এর বিচার দুর্গাপুর থানার ওসি নাজমুল হককে আদেশ (আদেশ নং-৪, তাং-০২ আগস্ট ২০২২) দেন। আদালতের আদেশে ওসি নাজমুল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জিএম মনিরুজ্জামানকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। গত ২৮ আগস্ট এসআই মনিরুজ্জামান তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে ওই মহিলা মৃত্যুবরণ করেনি মর্মে সংশ্লিষ্ট আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। একই দিন মোছা. জমেলা বেওয়া নামের ওই মহিলা মৃত্যুবরণ করেনি বরং সুস্থ্য অবস্থায় জীবিত আছেন মর্মে চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম আরেকটি প্রত্যয়নপত্র দেন।’

দেলুয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম। ফাইল ছবি

আবুল বাশার বলেন, ‘২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মো. রিয়াজুল ইসলাম। ২০২১ সালে নির্বাচনে আওয়ালী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান হন তিনি। প্রথম মেয়াদের ৫ বছরে শত শত অনিয়ম করার পরও দ্বিতীয়বার ক্ষমতার দাপটে পুনরায় চেয়ারম্যানের চেয়ার দখল করে রিয়াজুল। চেয়ারম্যানের আসন পেয়েই শুরু করেন নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অর্থ আত্মসাৎ।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘ইউনিয়নের হতদরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য চলতি মাসে জিআর এর ৬ মেট্রিকটন চাল আসে। গত ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬ জন ব্যক্তির মাঝে ৩.৫ মেট্রিকটন বা ৩ হাজার ৫০০ কেজি চাল বিতরণ করেন। বাকি ২.৫ মেট্রিকটন বা ২ হাজার ৫০০ কেজি (৫০ বস্তা) চাল ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে রাখা হয়। সেখান থেকে ১.৭ মেট্রিকটন বা ১ হাজার ৭০০ কেজি (৩৪ বস্তা) চাল (এই চালের আনুমানিক মূল্য ৬৮ হাজার টাকা) চেয়ারম্যান তার গাড়িচালক শামীমের মাধ্যমে চুরি করে বিক্রি করে দেন। ’

সংবাদ সম্মেলনে ইউপি সদস্য আরও জানান, ‘চেয়ারম্যান রিয়াজুল একজন মাছ ব্যবসায়ী। ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামে ৬০ জন কৃষকের কাছ থেকে ৭৬ বিঘা জমি নামমাত্র টাকায় ১০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে পুকুর খনন করেন। তিনি লীজের ডিড জালিয়াতি করে ১০ বছরের জায়গায় ১৩ মাসে বছর গণনা করে ১০ বছর ১০ মাস এর ভুয়া একটি ডিড তৈরী করে জোরপূর্বক ৬০ জন কৃষকের জমি দখল করে মাছ চাষ করে আসছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগী ৬০ জন কৃষক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগ দিয়ে কোনো প্রতিকার পায়নি। ভুক্তভোগী কৃষকরা চেয়ারম্যানের জোরপূর্বক ভোগদখলের বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করে।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে উপজেলার মহেন্দা এলাকার আক্কাছ আলী নামের এক ব্যবসায়ীকে একটি ফাঁকা চেক দিয়ে তার কাছ থেকে ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন চেয়ারম্যান। পরবর্তীতে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভুক্তভোগী আক্কাছ আলীর ছেলে সেন্টু আহমেদ বাদি হয়ে চেয়ারম্যান রিয়াজুলের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা করেন। পরে গ্রাম্য শালিশের মাধ্যমে মিমাংসা করে সমুদয় টাকা ফেরৎ দেয়া হয়। কিন্তু মিমাংসার নামে চেয়ারম্যান রিয়াজুল সেন্টু আহমেদের ছবি তুলে দেন। পাশাপাশি তার একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি কৌশলে নিয়ে নেন। এই ছবি ও জাতীয়পত্রের ফটোকপি দিয়ে সেন্টুর নামে চেয়ারম্যান তার ছোট ভাই সাইদুরকে দিয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দুর্গাপুর শাখায় ব্যাংকটির কর্মকর্তা আব্দুর রহমানের মাধ্যমে একটি ভুয়া একাউন্ট খোলেন। ভুক্তভোগী সেন্টুর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে খোলা ওই একাউন্টে চেয়ারম্যানের ভাই ৬১ লাখ ৫০ হাজার একটি চেক পাঠান। কিন্তু ওই একাউন্টে টাকা না থাকায় ভুক্তভোগী সেন্টুর নামে চেক জালিয়াতির মামলা করেন সাইদুর। সেই মামলা সেন্টুর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছিল। পরবর্তীতে আদালতের মাধ্যমে সেন্টুর জামিন হলে সেন্টুর বাবা আক্কাছ বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় খোঁজ-খবর নেন। প্রকৃত ঘটনাটি জানার পর ভুয়া একাউন্ট খোলার অভিযোগে চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম, তার ভাই সাইদুর রহমান ও ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী সেন্টু। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সেই মামলায় জামিন নিতে গেলে আদালত রিয়াজুল ও সাইদুরের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদেরকে জেলহাজতে পাঠায়। ওই সময় তারা দেড় মাস কারাগারে বন্দি ছিলেন। পরে উচ্চ আদালত থেকে বর্তমানে তার জামিনে রয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ইউপি সদস্য মো. তাজুল ইসলাম, মো. খলিলুর রহমান, মো. আফসার আলী, মো. আবুল খায়ের, মো. রহিদুল ইসলাম, সংরিক্ষত মহিলা সদস্য মোসা. সুবেদা খাতুন, মোসা. লাবনী খাতুন ও চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রতারণার স্বীকার প্রকৌশলী মো. মামুনুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়নের নির্বাচিত ইউপি সদস্যবৃন্দ


 

চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড় নিয়ে ৪ নম্বর দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়নের নির্বাচিত সদস্যগণের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলামের মুঠোফোনে অসংখ্যবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুল হক বলেন, ‘ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের অভিযোগের কথা মৌখিকভাবে শুনেছি। তবে এই ব্যাপারে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।’ জীবিত ব্যক্তিকে মৃত্যু পরবর্তীতে বেছে আছেন মর্মে চেয়ারম্যানের এমন প্রত্যয়নপত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনা সত্য। প্রথমে ওই মহিলা মারা গেছে মর্মে একটি প্রত্যয়ন দিয়েছিলেন পরে অবশ্য জীবিত আছেন মর্মে আরেকটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। বিজ্ঞ আদালত এই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে আদেশ দিয়েছিলেন। ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে সত্য রিপোর্টই আদালতে দাখিল করা হয়েছে।’

এএইচ/এস