দুদক কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি: বিচারাধীন সেই ধারা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনকে দুদক কর্মচারী বিধিমালার যে ধারায় (৫৪/২) চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল।

এর আগে দুদকের আরো দুই কর্মকর্তাকে এই ধারায় চাকরিচ্যুত করা হয়। এঁদের মধ্যে একজন প্রতিকার চাইলে হাইকোর্ট ধারাটি অবৈধ ঘোষণা করেন এবং ওই কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ দেন।  দুদক হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল অনুমতির আবেদন করে।

বিষয়টি এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এ অবস্থায় ৫৪ (২) ধারায় দুদকের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনের চাকরিচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এই কথাটি আমাদের সংবিধানেও বলা আছে। শরীফ উদ্দীনের ক্ষেত্রেও দুদকের এটি মেনে চলা উচিত ছিল। ’

দুদক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২৮ জুন গোলাম রহমান দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর প্রথম ৫৪(২) ধারার প্রয়োগ হয়। তিনি দুদকের সাবেক উপপরিচালক আহসান আলীকে ওই ধারায় অপসারণ করেন। একই ধারায় উপপরিচালক শফিকুল ইসলামকেও অপসারণ করা হয়।

তাঁদের মধ্যে আহসান আলী ধারাটি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। তাঁর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ধারাটি বাতিল করেন। একই সঙ্গে তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ দেন। পরে দুদক হাইকোর্টের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে লিভ টু আপিল করে। আপিল বিভাগ পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। লিভ টু আপিলের আবেদন এখনো চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি।

এ বিষয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘আমি এই ধারাটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলাম। কারণ তখন আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। আমার মনে হয়েছিল, ওই কর্মকর্তাকে কমিশনে কোনোভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত নয়। ’

শরীফ উদ্দীনের অপসারণের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে দুদকের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে পরিষ্কার না জেনে কিছু বলা মুশকিল। দুদকের উচিত, গুরুতর কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা প্রকাশ করা। বিভাগীয় মামলা দিয়ে সমাধান করা যায়, এমন বিষয়কে এ ধারায় এনে প্রয়োগ করা সমীচীন নয়। ’

উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনকে দুদক আইনের ৫৪(২) ধারায় গত বুধবার অপসারণ করা হয়। সর্বশেষ তিনি দুদকের পটুয়াখালী সমন্বিত কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালিয়ে ও প্রতিবেদন দিয়ে আলোচনায় আসেন।

গত ৩০ জানুয়ারি প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এতে তিনি পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির (কেজিডিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইয়ুব খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এর ১৬ দিনের মাথায় তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, শরীফ উদ্দীনের উপস্থিতি দুদকের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় কমিশনের বৈঠকে তাঁকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, দুদক বলছে, শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু অভিযোগ থাকলেও ৫৪(২) ধারা প্রয়োগ করে চাকরি থেকে অপসারণ করা বেআইনি। কারণ সংবিধান অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে কেন চাকরিচ্যুত করা হবে না, জানতে চেয়ে চিঠি দিতে হবে। এরপর চিঠির জবাবে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট না হলে তদন্ত করে দোষী সাব্যস্ত হলে ব্যবস্থা নেবে।

শাহদীন মালিক আরো বলেন, এখানেও কথা আছে। দোষী হলেও শাস্তির মাত্রা হবে অপরাধের ওপর ভিত্তি করে। সর্বনিম্ন বেতন কাটা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শাস্তি বরখাস্ত করতে পারবে। শরীফের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই মানেনি দুদক।

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম বলেন, শরীফ উদ্দীনকে প্রচলিত সরকারি চাকরির বিধিমালায় নয়, দুদকের নিজস্ব বিধিতে অপসারণ করা হয়েছে। প্রচলিত বিধিমালায় কাউকে অপসারণ করতে হলে কারণ দর্শানোর নোটিশ, সশরীরে শুনানি, খসড়া তৈরি, সাময়িক বরখাস্ত, অধিকতর তদন্ত, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো প্রভৃতি প্রক্রিয়া মানতে হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুদক যে ধারায় শরীফ উদ্দীনকে অপসারণ করেছে, সেটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ ধারা। কারণ এই ধারাটিকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। শরীফ উদ্দীন আইনি প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্যই তিনি রোষানলে পড়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না মনে করেন, শরীফ উদ্দীনের বেলায় সংবিধানের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি মানা হয়নি।   ভুক্তভোগী শরীফ চাইলে দুদকের এমন আচরণের প্রতিকার পেতে আদালতে যেতে পারেন।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ