দুই ‘বৃক্ষমানব’–এর মুখেই হাসি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

একজন তরুণ। আরেকজন শিশু। একে অপরের কষ্ট বুঝতে পারে। তারা ‘বৃক্ষমানব’ হিসেবে পরিচিত। দুজনই বিরল রোগের কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি। তরুণের নাম আবুল বাজনদার আর আট বছরের শিশু রিপন দাস। আবুল হাসপাতালে ভর্তি প্রায় নয় মাস ধরে। আর রিপন আছে দেড় মাস ধরে। আবুল বাজনদার পাঁচতলা থেকে মাঝেমধ্যে ছয়তলায় ‘চাইল্ড নন একিউট ওয়ার্ড’-এ রিপনকে দেখতে যান।
গতকাল শনিবার দুপুরে রিপনের বিছানার পাশে তাদের সঙ্গে কথা হয়। আবুল বাজনদারের স্ত্রী হালিমা বেগম ও মেয়েও সেখানে হাজির হন। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের ধারণা, আবুল বাজনদার ও রিপন দাস ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ রোগে আক্রান্ত। রোগটি ‘ট্রি-ম্যান’ (বৃক্ষমানব) সিনড্রোম নামে পরিচিত।
শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় দুই হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে রিপন বসে আছে। দুই হাতেই অস্ত্রোপচার হয়েছে। সাত দিন পর ব্যান্ডেজ খোলা হবে। পাশে বসে মা গোলাপি ছেলের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। অপুষ্টির কারণে রিপনের ঠোঁটের চারপাশে ঘা। তবে মুখে হাসির কমতি নেই। দুই পা খোলা, তা গাছের শিকড় বা বাকলের মতো শক্ত হয়ে আছে।
আবুল বাজনদারের বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ নেই। দুই পা ও ডান হাতে মোটা করে ব্যান্ডেজ লাগানো। হাঁটার সময় দুই পায়ে পলিথিন লাগিয়ে হাঁটেন। প্রায় আট বছর পর নিজের হাত-পা স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারছেন বলে তাঁর মুখের হাসি যেন থামেই না।
আবুল বাজনদারের পরিচয় জানতে চাইলে রিপন একগাল হেসে বলে, ‘উনিও আমার মতো বৃক্ষমানব।’ পাশে বসা বাজনদার হাত দিয়ে রিপনকে জড়িয়ে ধরে জানালেন, মাঝেমধ্যে তিনি রিপনকে দেখতে আসেন।
শিকড় গজানো হাত-পা নিয়ে আবুল বাজনদার যখন গত ৩০ জানুয়ারি বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তাঁর হাত-পায়ের কোনো আকৃতিই স্পষ্ট ছিল না। সে তুলনায় রিপনের হাত-পায়ের আঙুলগুলো বেশ স্পষ্ট বলে জানালেন চিকিৎসক নূরুন্নাহার লতা। আবুল বাজনদারের অনেক বড় বড় শিকড়ের কারণে হাত-পায়েরই ওজন ছিল অনেক বেশি। রিপনের সে সমস্যা ততটা প্রকট নয়।
বাজনদার এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিন বছর বয়সী মেয়েকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন দেখছেন বলে জানালেন। আর রিপনের চোখেমুখে স্কুলে যাওয়ার আকুলতা। সে জানাল, তার কোনো বন্ধু নেই। অন্য বাচ্চাদের কাছে গেলে সবাই ভয় পেত বা তাকে দূরে সরে যেতে বলত। স্কুলে গেলে শিক্ষকেরাও পেছনে এক কোনায় বসতে দিতেন।
রিপন বলল, ‘ভালো হইলে ইশকুলে যাব। লেখাপড়া করব। বড় হয়ে চাকরি করব।’ তার মা গোলাপি জানালেন, রিপনের বাবা মহেন্দ্র রাম দাস ঠাকুরগাঁওয়ে কৃষিকাজ করেন। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। জন্মের পর প্রথম দুই-তিন মাস ভালো ছিল রিপন। তারপর থেকেই সমস্যা দেখা দেয়। কবিরাজি থেকে শুরু করে অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। বার্ন ইউনিটে ভর্তির পর থেকে ছেলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে, সে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন।
অন্যদিকে খুলনার আবুল বাজনদারের বয়স যখন ১৫ বছর, তখন তাঁর ডান হাঁটুর নিচে আঁচিলের মতো একধরনের গোটা উঠতে থাকে। পরে দুই হাতের কনুই পর্যন্ত এবং দুই পায়ের হাঁটু পর্যন্ত আঁচিলে ভরে যায়। দুই হাতের তালুর চামড়া এবং ১০টি আঙুল প্রসারিত হয়ে গাছের শিকড়ের মতো হয়ে যায়। পায়ের আঙুল আর তালুতেও একই অবস্থা। হাত ও পা গাছের শুকনো বাকলের মতো মনে হতে থাকে।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম বলেন, আবুল বাজনদারের হাত ও পায়ে অস্ত্রোপচারের পর এখন পর্যন্ত আর নতুন করে শিকড় গজায়নি। এটি একটি ইতিবাচক দিক। রিপনের অবস্থাও ইতিবাচক। চিকিৎসার প্রয়োজনে বাজনদার ও রিপনকে যত দিন প্রয়োজন তত দিন হাসপাতালে রাখা হবে।
তাদের চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম ইউ কবির চৌধুরী বাজনদারকে জমি কিনে বাড়ি তৈরির জন্য টাকা দিয়েছেন। সেই টাকায় বাজনদার এখন সাড়ে তিন কাঠা জমির মালিক।

সূত্র: প্রথম আলো