দুই বন্ধুর পরিবার একসঙ্গে ভ্রমনে গিয়েছিলেন নেপালে, লাশ হয়ে ফিরবেন রাজশাহীতে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় রাজশাহীর মোট ৫জন বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও একজন। সবমিলিয়ে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় রাজশাহীর হতাহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬জনে। তাঁর তিন জোড়া দম্পতি ছিলেন। এঁদের মধ্যে একটি পরিবার রাজশাহীতে ভাড়া থাকতেন, আর বাকি দুটি পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। তিন পরিবারের তিন নারীই ছিলেন পেশায় শিক্ষক।

দু’জন অবসর নিয়েছিলেন। আর একজন বর্তমানে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষক হিসেবে আছেন। ছয়জনের মধ্যে রুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ইমরানা কবির হাসি এখন পর্যন্ত জীবিত রয়েছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দপ্তর থেকে দেওয়া তালিকা সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া নিহতরা হলেন, রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকার বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত যুগ্নসচিব হাসান ইমাম এবং তার স্ত্রী এবং নাটোরের লালপুর কলেজের শিক্ষক হুরুন নাহার বিলকিস বানু, রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা ও বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী এবং রাজশাহী মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আক্তার বেগম।

নিহত অপরজন হলেন ঢাকায় একটি সফটওয়্যার কম্পানীতে কর্মরত কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান। রাকিবুল হাসান তাঁর স্ত্রী এবং রুয়েটের শিক্ষক ইমরানা কবির হাসির সঙ্গে নেপাল ভ্রমন করতে গেছিলেন। আর নজরুল ইসলাম ও হাসান ইমাম ছিলেন পরস্পর বন্ধু। তাঁরা তাঁদের স্ত্রীকে নিয়ে একইসঙ্গে নেপাল ভ্রমনে বের হয়েছিলেন। কিন্তু নেপাল ভ্রমন তো দূরের কথা এখন লাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হবে দুই বন্ধু ও তাদের দুই স্ত্রীদের।

এদিকে রাজশাহীর নিহত ৫ জনের মধ্যে চারজনের লাশের অপেক্ষায় আছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। রাজশাহীতেই তাদের চারজনের দাফন সম্পন্ন হবে বলেও জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ফলে লাশের অপেক্ষায় এখন শোক সন্তপ্ত পরিবার দুটির দিন কাটছে।

নিহত মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামের মেয়ে এবং একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী নারগীস আক্তার কাকন জানান, নেপালের কাঠমুন্ডুতে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস বাংলার যে বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন তাতে তার বাবা-মা ছিলেন। সোমবার রাতেই তাঁরা নিশ্চিত হোন ওই দুর্ঘটনায় তাঁর বাবা-মাও নিহত হয়েছেন। তাঁর বাবা-মায়ের লাশ নিতে গতকাল সকালে নেপালে যান কাকনের মামা চিকিৎসক মইনুদ্দিন চিশতী এবং মেয়ে নুসরাত আলী।

নজরুল ইসলামের বড় মেয়ের নাম সানজিদা আক্তার কনকের স্বামী এ্যাডভোকেট এমরান আলী বলেন, তাঁর শ্বশুর একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি গ্রামে। তবে দীর্ঘদিন ধরে নজরুল ইসলাম রাজশাহী নগরীর উপশহরে বসবাস করতেন। সম্প্রতি ছোট মেয়ে কাকন ঢাকায় পড়া-শোনা করায় নজরুল ইসলাম তাঁর স্ত্রী আক্তার বেগমকে নিয়ে অধিকাংশ সময় বড় মেয়ের বাড়ি ঢাকার মীরপুর ১০ এ থাকতেন। সেখান থেকেই নেপাল ভ্রমনের জন্য বিমানযোগে সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন। তবে লাশ কোথায় দাফন হবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারপরেও রাজশাহীতে দাফন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি আছে।

এদিকে, রাজশাহী বরেন্দ্র করেজের অধ্যক্ষ আলমগীর মালেক সিল্কসিটি নিউজকে জানান, নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে তাঁর বোন হুরুন নাহার বিলকিস বানু এবং দুলাভাই হাসান ইমামও রয়েছেন। তাঁরা দু’জনেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বোন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক আর দুলাভাই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব। তারা দুজনেই আর বেঁচে নেন বলে তাঁরা মনে করছেন। এ কারণে এখন লাশের অপেক্ষায় সময় কাটছে তাদের। লাশ রাজশাহীতে এলেই এখানে তাদের দাফন সম্পন্ন করা হবে।
হাসান ইমাম ও নজরুল ইসলাম পরস্পর বন্ধু ছিলেন। তাদের পারিবারিকভাবেও যাতায়াত ছিল। এ কারণেই দুই বন্ধু এবং তাঁদের দুই স্ত্রীকে নিয়ে নেপাল ভ্রমনে বের হয়েছিলেন তাঁরা।

সাবেক যুগ্নসচিব হাসান ইমাম অবস জীবনেও ব্যাপক পড়া-শোনা করতেন বলে দাবি করেন অধ্যক্ষ আলমগীর মালেক। তিনি আরবি, ফারসি, ইংরেজীসহ বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরের নামো সংকপুর গ্রামে। হাসান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী হুরুন নাহার বিলকিস বানুর দুই সন্তান কানাডায় থাকেন।

তাঁদের মধ্যে বড় ছেলে কাইছার ইমাম আইটিতে চাকরি করছেন। আর ছোট ছেলে তৌকির ইমাম একই বিষয়ে ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করে কানাডায় গিয়ে পড়া-শোনা করছেন। বিমান দুর্ঘটনায় বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর তাঁদের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। খবর শুনে তাঁরা দুজনেই কানাডা থেকে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। তারা দেশে আসার পরেই তাঁদের বাবা-মায়ের লাশ রাজশাহীতে এনে দাফন করা হবে।

এদিকে ইমরানা কবির হাসি ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর স্বামী রকিবুল হাসান ঢাকায় একটি বেসরকারি সফটওয়ার কম্পানিতে চাকরি করেন। ওই শিক্ষিকা রাজশাহীর মুন্নাফের মোড় এলাকায় ভাড়া থাকতেন।

তার স্বামীও রুয়েটের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরা দুজনেই ইউএস বাংলার বিধ্বস্ত হওয়া বিমানের যাত্রী ছিলেন। ইমরানা কবির হাসি ছুটি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে নেপাল ভ্রমন যাচ্ছিলেন। নেপাল যাওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে সেলফিও তুলেছিলেন দুজনে মিলে।

এ ব্যাপারে রুয়েটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহা. রফিকুল আলম বেগ বলেন, ‘হাসি ও তার স্বামী ছুটি কাটাতে নেপাল যান। তাঁরা ওই বিমানের যাত্রী ছিলেন। কিন্তু দুর্ঘটনার বিষয়টি অনাকাঙ্খিত। তাদের মধ্যে হাসি মারা গেছে বলে শুনেছি।’

অপরদিকে, আহত রুয়েট শিক্ষিকা ইমরানা কবির হাসির অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তারা শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। রুয়েট উপাচার্য অধ্যাক ড. মো. রফিকুল আলম বেগ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

হাসির মামাশ্বশুড়ের বরাত দিয়ে উপাচার্য জানান, ‘হাসির শ্বাসনালীসহ শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ৭২ ঘণ্টা পর তার অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। এ ছাড়া হাসির বাম হাতে বড় ধরনের জখমের চিহ্ন রয়েছে।’

হাসির বাবা হুমায়ুন কবির পেশায় একজন ব্যাংকার। তার বাড়ি টাঙ্গাইলে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার জামাই তো মারাই গেল। বিমানে ওঠার আগে আমাদের সবার কাছেই ওরা দোয়া চেয়েছিল। এখন হাসির অবস্থাও ভাল নয়। আপনারা আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।’ ঘটনার পরপরই রাকিবের মামাতো ভাই জুয়েল নেপালে যান।

স/আর